ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সহকারী মেহের আলী সেদিনের পাক আর্মির গুলির চিহ্ন শরীরে বহন করছে ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর

ত্রিমোহনীর যুদ্ধে আমার ব্রাশফায়ারেই ১০ পাকসেনা মরল

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

ত্রিমোহনীর যুদ্ধে আমার ব্রাশফায়ারেই ১০ পাকসেনা মরল

আরাফাত মুন্না ॥ ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকার পূর্বাঞ্চল ত্রিমোহনীতে তিনটি খালের মোহনা দখলে নেয় পাক আর্মি। ওই খাল দিয়েই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করত। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ত্রিমোহনীর তিন খালের মোহনা আমরা দখলমুক্ত করব। সে অনুযায়ী আশপাশের সব ক্যাম্পে খবর পাঠানো হলো। সবাই আসার পর আক্রমণ শুরু হলো। সারাদিন যুদ্ধ চলল। ওই যুদ্ধে ১৫ জনেরও বেশি পাকসেনা নিহত হয়। এদের মধ্যে ১০ জনকে আমিই মেরেছিলাম। আমি যখন একের পর এক পাকসেনা খতম করছিলাম তখন আমার সহকারী মেহের আলী খুশিতে লাফ দিয়ে উঠতেই পাকবাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত হয়। আজও যুদ্ধের সেই স্মৃতি নিয়ে মেহের বেঁচে আছে। এভাবে নিজের যুদ্ধদিনের কথা জনকণ্ঠের কাছে বর্ণনা করছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান শহীদ। বুধবার জনকণ্ঠের কাছে যুদ্ধদিনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ৩ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে তৎকালীন পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। আমি স্টেডিয়ামেই ছিলাম। একটি ঘোষণার মাধ্যমে সংসদ বন্ধ করে দেয়া হলো। ওই ক্ষোভে সাধারণ মানুষ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আগুন ধরিয়ে দিল। পরে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। ওদিন বিকেলবেলায়ই পূর্বাণী হোটেলে বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন করলেন। আমরাও পূর্বাণী হোটেলের সামনে ভিড় করেছিলাম। ওই সংবাদ সম্মেলনে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সমাবেশ আহ্বান করা হলো। ৭ মার্চের ভাষণের সময়ও আমি ওই সমাবেশে ছিলাম। ওই সমাবেশে তিনি যে সকল নির্দেশ দিলেন সাধারণ মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল, তিনিই অঘোষিত রাষ্ট্রপ্রধান। আমরাও বঙ্গবন্ধুর ভাষণে দেয়া নির্দেশ পালন করতে থাকি। শফিকুর রহমান বলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাক আর্মির হামলার পর থেকেই ঢাকা শহরে তরুণ যুবকদের গ্রেফতার ও হত্যা শুরু হয়। আমরা তখন ৫১২ সি খিলগাঁওয়ের বাসাই থাকতাম (বর্তমানেও এই বাসায়ই আছেন)। সারাদিন আমরা মহল্লায় থাকতাম আর সন্ধ্যার পর গ্রামের দিকে চলে যেতাম। এক সময় ভাবলাম এভাবে আর চলতে পারে না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হতো, সেই আহ্বানে সাড়া দেব। বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ভারতে যাবার আগে খিলগাঁও হাইস্কুলে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে আমরা ডামি রাইফেল বানিয়ে ট্রেনিংও করেছি। তিনি বলেন, এপ্রিলের শেষদিকে আমাকে বাসা থেকে রেশন তোলার জন্য ২৫ টাকা দেয়া হলো। ওই রেশনের টাকা নিয়েই আমি বাসায় না বলে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করি। প্রথমে রামচন্দ্রপুর হয়ে কসবা। সেখান থেকে আগরতলা চলে যাই। আগরতলা কংগ্রেস ভবনে অবস্থান নেই। সেখান থেকে শুনলাম নেতৃবৃন্দ কলেজ টিলায় থাকে। আমরা কয়েকজনও নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে কলেজ টিলায় যাই। নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকজন আমার পরিচিত। এর মধ্যে আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নারায়ণগঞ্জের শামিম ওসমানের পিতা শামসুজ্জোহাসহ অনেকেই ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা ওখানে যাওয়ার পর আমার এলাকার সাথী বন্ধু, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য শহীদ আব্দুল্লাহিল বাকি এসে আমাকে বলল উচ্চতর ট্রেনিং হবে, তোমাকে সেখানে পাঠানো হবে। তুমি এখন কোথাও যেওনা। আমাকে নিয়ে আগরতলার বটতলা একটা ক্যাম্পের ইনচার্জ করে দিল। বাংলাদেশ থেকে যারা যায় ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে তারা ওই ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। আমার এই কাজ ভাল লাগছিল না। পরে আমি আবার কলেজ টিলায় যাই। সেখানে গিয়ে নেতৃবৃন্দকে বললাম, আমি এই দায়িত্ব পালনের জন্য আসিনি। আমি যুদ্ধ করব, আমাকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠান। তিনি বলেন, পরে অসমের হাফলং ট্রেনিং ক্যাম্পে চলে যাই। হাফলং ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ফুট উপরে। দুই মাস আমরা ট্রেনিং নেই। ট্রেনিং শেষে আমরা আবার আগরতলায় চলে আসি। ট্রেনিং শেষ করে সবাই আগরতলায়ই আসত। ওখান থেকেই গ্রুপ ভাগ করে এলাকাভিত্তিক দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হতো। তিনি আর বলেন, আর্মিতে যে ট্রেনিং নয় মাসে দেয়া হতো সেই একি ট্রেনিং আমাদের দুই মাসে দেয়া হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ট্রেনিং দেয়া হয়েছে আমাদের। যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় যুদ্ধ করব। পরে কামরুল হাসান খান খসরু ভাইয়ের গ্রুপে আমি অন্তর্ভুক্ত হই। ঢাকার রূপগঞ্জের বাইনাপাড়ায় আমাদের ক্যাম্প ছিল। একদিন ক্যাম্পে পাহারারত অবস্থায় আমরা দেখি একটি নৌকায় কিছু মুক্তিযোদ্ধা আসছে। কিন্তু আমরা ভাবি ওরা শত্রুও হতে পারে। আমরা তাদের থামিয়ে দেই। পরে দেখি আমার সেই পুরনো বন্ধু বাকি তার গ্রুপ নিয়ে ঢাকায় ঢুকছে। আমাকে দেখে সে খুব খুশি হয়ে বলল তুমি আমার দলে চলে আস। বাকির কথামতো আমিও তার দলে চলে যাই। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, একদিন আমাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দার নির্দেশ দিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র উপস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। ওই উপস্থিতি কমাতে সেখানে অপারেশন করতে হবে। তবে নির্দেশ ছিল কোন বাঙালী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমার কমান্ডার বাকি আমাকে বললেন সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে। আমি আমার দুই বন্ধুকে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে গ্রেনেড চার্জ করি। এই ধামাকার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপস্থিতি একদম নিম্নস্তরে চলে আসে। আমাদের গেরিলা ট্রেনিংই ছিল হিট এ্যান্ড রান। সে অনুযায়ী অনেক অপারেশন করেছি। সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ঢাকার গেরিলা যোদ্ধারা বিশেষ করে ঢকার পূর্বাঞ্চলের ইছাপুরা, নগরপাড়া, শেখের টেক, নন্দীপাড়া, মাদারটেক অঞ্চলেই ক্যাম্প করেছিল। এসব ক্যাম্পের মধ্যে গাজী গোলাম দস্তগীরের গ্রুপ, মায়া গ্রুপ, নজির গ্রুপ, লেয়াকত গ্রুপ, বাকি গ্রুপ অবস্থান নিয়েছিল। এদের সবারই টার্গেট ঢাকা। আমরা জানতে পারলাম ঢাকার পূর্বাঞ্চলের ত্রিমোহনীতে পাক আর্মি অবস্থান নিয়েছে। ত্রিমোহনী ছিল তিনটি খালের মোহনা। ওই জায়গা দিয়ে আশপাশের সব জায়গায় যাওয়া যেত। খবর পেয়ে ১১ ডিসেম্বর সকালবেলায় আশপাশের সব গ্রুপই সেখানে অবস্থান নেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটা একটা করে গুলি চালাব। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওই যুদ্ধ চলে। ওই দিন ওখানে ১৫ জনেরও বেশি পাক আর্মি নিহত হয়। এদের মধ্যে অনেকেই স্পট ডেড। সেদিন এক কোম্পানি পাক আর্মি সেখানে অবস্থান নিয়েছিল। ওই যুদ্ধে আমার প্রত্যেকটা গুলিই ইফেকটিভ হয়েছে। আমার জানামতে আমার গুলিতে ওইদিন কমপক্ষে ১০ পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান বলেন, আশপাশে অনেক গ্রুপ থাকলেও আমাদের বাকি গ্রুপের অবস্থান ছিল মুখোমুখি। তিনি বলেন, আমার গুলিতে যখন একের পর এক পাক আর্মি নিহত হচ্ছিল তখন আমার সহকারী মেহের আলী খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে। ও সময় পাক আর্মির ব্রাশ ফায়ারে মেহের আলী গুরুতর আহত হয়। তিনি বলেন, আমি এসএলআর চালাতাম আর মেহের আলী আমাকে পেছন থেকে গুলিভর্তি ম্যাগজিন সরবরাহ করত। মেহের এখন গুলির চিহ্ন শরীরে নিয়ে বেঁচে আছে বলে জানান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান শহীদ যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে বিএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজমে ভর্তি হন। তিনি বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত। এই মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে।
×