ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন ;###;পদ্মা সেতু ছাড়া আরও ৯ মেগা ;###;প্রকল্প দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন

বাজেট তৈরি শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

বাজেট তৈরি শুরু

এম শাহজাহান ॥ চার লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে দারিদ্র্য বিমোচনে। অবকাঠামো উন্নয়নে পদ্মা সেতুর পাশাপাশি আরও ৯ মেগা প্রকল্প দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ থাকবে নতুন বাজেটে। এজন্য বরাদ্দও বাড়ানো হবে। আয় বাড়াতে করদাতার সংখ্যা ১১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২০ লাখে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ট্যাক্স- জিডিপি বাড়াতে আয়কর প্রদানে সক্ষম এমনসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করজালে নিয়ে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে আগামী বাজেটে ২৫০ জনকে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞদের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেখানে তিনি আগামী বাজেটের সম্ভাব্য একটি রূপরেখা তুলে ধরবেন। এর পর জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা হবে অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত চলতি বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি রিপোর্ট। সেখানে প্রকাশ করা হবে নতুন বাজেটের আকার। যদিও অর্থমন্ত্রী সচিবালয়ে অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভায় সম্প্রতি জানিয়েছেন, আগামীতে ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হবে। সরকারের শেষ অর্থবছরে ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, এই বাজেট অর্থমন্ত্রী স্বয়ং নিজে ঘোষণা দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক অনুষ্ঠানে মুহিত বলেন, এই সরকারের শেষ সময় ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান যুব সমাজ যেভাবে কর প্রদানে এগিয়ে আসছে তাতে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা অসম্ভব কিছু নয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। সেই বাজেটের আকার প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমান ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে যে প্রস্তুতি রয়েছে তাতে আগামী অর্থবছরে সোয়া চার লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে বর্তমান সরকারের। বাজেটের আকার এবং আয়-ব্যয় নিয়ে অর্থ বিভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সোয়া চার লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও কোন কিছু চূড়ান্ত করা হয়নি। তিনি বলেন, বাজটের আকার কিছুটা বাড়তে পারে বা কমতে পারে। বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের আয় যেমন বাড়ছে তেমনি ব্যয়ের খাতও বেড়ে যাচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন ভাল অবস্থায়। এদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভায় আগামী বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সভায় বাজেটের সম্ভাব্য আকার প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) হচ্ছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। দুই লাখ ৮১ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার রাজস্ব আয় ছাড়াও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। নতুন বাজেটে এনবিআর কর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এনবিআর কর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আকার ধরা হচ্ছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বাস্তবায়নের সক্ষমতার চ্যালেঞ্জ নিয়েই আগামী বছর বড় এডিপির আকার ঠিক করা হচ্ছে। অবশ্য গত অক্টোবর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের মোট হার বরাদ্দের ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। এই চার মাসে বাস্তবায়ন গত বছরের তুলনায় আড়াই শতাংশ বেশি। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ৬ শতাংশ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় দশমিক ৫ শতাংশ কম। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরা হচ্ছে তা চলতি বাজেটের তুলনায় ৩৮ হাজার ৯১২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। জানা গেছে, আগামী বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া খাতগুলো হচ্ছে-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এর পরই মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে এবারের মতো শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট প্রণয়ন করা হবে। নারী অধিকার রক্ষা এবং অর্থনীতির মূল ধারায় নারীকে নিয়ে আসতে আবারও জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। পদ্মা সেতুসহ দ্রুত সময়ে বাস্তবায়িত করা হবে মোট ১০টি প্রকল্প। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ থেকে রক্ষায় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ রাখা হবে। এজন্য বিল্ডিং কোড পরিবর্তন করবে সরকার। ঘাটতি কমিয়ে আনতে সব ধরনের ভর্তুকি ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। এছাড়া আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এলক্ষ্যে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বয় করা হবে যাতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পায় এবং মুদ্রার বিনিময় হার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে থাকে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই সরকারের এই ঘোষণা কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ৬টি খাত ॥ আসছে বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে ৬টি খাতে আর তা হলো-স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদ্যুত, জ্বালানি, সড়ক, রেলপথ ও বন্দরসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসৃজন প্রকল্প, সরকারী সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন, জলবায়ু মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন এবং বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিকতর ব্যবহার ও প্রবাস আয় বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রফতানি বাজার অনুসন্ধান। এছাড়া নতুন বাজেটে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে তা হচ্ছে-চল্লিশটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জেন্ডার বাজেট রিপোর্ট প্রণয়ন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও এ সংক্রান্ত একটি নতুন ধারণাপত্র প্রণয়ন এবং শিশু বাজেট ও ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা হালনাগাদ করা। ১০ মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ছে ॥ পদ্মা সেতুসহ ১০ মেগা প্রকল্পের জন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ১০টি মেগা প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ‘কাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্প : প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে নতুন মাত্রা’ শীর্ষক একটি পৃথক বাজেট বইও প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের অধীনে এডিপির আওতায় অবকাঠামো খাতের ফার্স্ট ট্র্যাক হিসেবে চিহ্নিত ১০টি প্রকল্পের মধ্যে আটটি প্রকল্পের (এলএনজি ও সোনাদিয়া ব্যতীত) মোট প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটেই এই দশ প্রকল্পের জন্য এডিপিতে মোট ১৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট এডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে এই বরাদ্দ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এদিকে মেগা প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চললেও রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুত প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে ধীরগতিতে। যদিও পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ও মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি ভাল। ফার্র্স্ট ট্র্যাক হিসেবে এসব প্রকল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। প্রথম পর্যায় মেগা ৬টি প্রকল্পকে ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তী সময়ে যুক্ত করা হয় মাতারবাড়ি বিদ্যুতকেন্দ্র ও পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প।
×