ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কক্সবাজারে ৭৪ জেলের সন্ধান মেলেনি

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

কক্সবাজারে ৭৪ জেলের সন্ধান মেলেনি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ৭৪ জন জেলের সন্ধান মেলেনি একমাসেও। তারা কি মারা গেছেন, না-কি বেঁচে আছেন, তা জানে না তাদের স্বজনরা। ওসব জেলে পরিবারে একমাস ধরে চলছে শোকের মাতম। গত ৬ নবেম্বর ঘুর্ণিঝড় নাডার সময় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরারত অবস্থায় ছিলেন ওসব জেলে। ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ওইসময় তিনটি ট্রলার কূলে ভিড়াতে পারেনি। সাগরে ভাসমান অবস্থায় ট্রলারগুলো হয়ত মিয়ানমারে অথবা ভারতে গিয়ে ভিড়েছে বলে জেলে পরিবারের সদস্যদের ধরণা। এদের উদ্ধার করতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন শহরের কুতুবদিয়াপাড়া ও সমিতিপাড়ার নিখোঁজ ওই জেলে পরিবারের স্বজনরা। জানা গেছে, সাগর থেকে তিন সপ্তাহ পর তিন ব্যক্তি ফিরে আসায় জেলে পল্লীতে কান্নার ভেতর কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল। সকলের সঙ্গে নিখোঁজ হয়ে পড়া তিন জেলে ২৪ দিন পর ফিরে আসে নিজ বাড়ি উখিয়ার সোনার পাড়ায়। তাদের কাছ থেকে স্বজনরা জীবিত এবং সাগরে ভাসমান অবস্থায় আছে এ তথ্য পেয়ে মা-বাবা, ভাই বোন ও স্ত্রী সন্তানরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। তবে পরবর্তীতে সরকারী বেসরকারী কোন সংস্থার তরফ থেকে নিখোঁজদের কোন সন্ধান না পাওয়ায় ফের হতাশায় ভার করেছে ওসব পরিবারে। তাদের স্বজনদের বুকফাটা কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বাতাশ। প্রতিরাতে বিলাপ ধরে কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রতিবেশীর। কেউ আদরের সন্তানকে হারিয়ে, আবার কেউ প্রিয় স্বামীকে, কেউবা পিতা বা ভাইকে হারিয়ে বর্তমানে নির্বাক। এদের শান্তনা দেয়ার যেন কেউ নেই। ওসব পরিবারে প্রতিদিনই চলছে আহাজারি। নিখোঁজ জেলেদের পরিবারে চরম অর্থ সঙ্কট চলছে। অনেকের দিন কাটছে না খেয়ে। শোকার্ত পরিবারগুলোর পাশাপাশি অঝোরে কাঁদছে তাদের প্রতিবেশীরাও। পুরো এলাকা জুড়ে এখন শুধুই কান্নার রোল। এক মাস ধরে অপেক্ষায় থাকা জেলে পরিবারে হতাশ সদস্যদের মনে একটু হলেও আশার আলো জ্বালিয়েছিল ২৪ দিন পর ফিরে আসা ভাসমান তিন জেলেকে দেখে। গভীর বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরা উখিয়ার সোনারপাড়ার হোছন মাঝি, আব্দুল্লাহ ও শফিউল করিম জানান, ইঞ্জিন বিকল হয়ে আরও তিনটি ট্রলারে বেঁচে থাকা অন্য জেলেরা হয়ত এখনও গভীর সাগরে পানিতে ভাসছে। নতুবা সাগরের স্রোতে পার্শ্ববতী দেশে ভিড়ে আটকা পড়েছে। গত ৩ নবেম্বর তারা এফবি সাজ্জাদ, এফবি রেশমি, এফবি জায়েদ এবং এফবি আল্লাহর দান ফিশিং ট্রলারে করে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। কিন্তু, ৬ নবেম্বর ঘূর্ণিঝড় নাডা’র কবলে পড়ে ফিরতে পারেননি কেউ। সেই থেকে তারা এখনও নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ জেলেদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এফবি সাজ্জাদ ফিশিং ট্রলারের ছৈয়দ মাঝি ও জামাল মাঝির নেতৃত্বে ২৯ জন, এফবি জায়েদ ফিশিং ট্রলারের মোক্তার মাঝি ও রুবেলের নেতৃত্বে ১৬ জন, এফবি সুমি ফিশিং ট্রলারের মিনহাজ মাঝি ও মানিক মাঝির নেতৃত্বে ২৬ জন জেলে বঙ্গোসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে আর ফিরতে পারেনি। স্থানীয়রা বলেন, নিখোঁজ ৭৪ জেলের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল তাঁদের পরিবার। সেই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিখোঁজ থাকায় দিশেহারা স্বজনরা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে এখনও কোন সহযোগিতা দেয়া হয়নি। ওসব পরিবারকে জরুরি ভিত্তিতে সহযোগিতা দেয়া দরকার। তারা আরও বলেন, পাশের দেশগুলোতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালালে হয়ত নিখোঁজ জেলেদের সন্ধান মিলতে পারে। ২৪ দিন পর ফিরে আসা জেলে হোছন মাঝি ও আব্দুল্লাহ বলেন, বঙ্গোপসাগরে খুব কাছাকাছি স্থানে আমরা মাছ ধরছিলাম। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি। বাতাসের গতিবেগ এত বেশি ছিল, ওসময় তীরে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। এরপর কূল-কিনারা হারিয়ে ভাসতে থাকি। গভীর সাগরে কিছু মালবাহী জাহাজ চলাচলের দৃশ্য চোখে পড়ে তাদের লাল কাপড়ের সঙ্কেত দেয়ার পরও উদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসেনি। ভাসতে ভাসতে মিয়ানমার উপকূলে গিয়ে পৌছি তিন জেলে। ওই দেশের দুই জেলের সহযোগিতায় ফিরে আসি নিজ নিজ ঘরে। তারা জানান, গভীর বঙ্গোপসাগরে আরও তিনটি ট্রলারকে ভাসতে দেখা গেছে। ওই ট্রলারগুলো কক্সবাজারের কুতুবদিয়াপাড়া ও সমিতিপাড়ার ভেসে যাওয়া নিখোঁজ জেলেদের। কুতুবদিয়াপাড়ার নিখোঁজ মিন্টুর পিতা ছালেহ আহমদ বলেন, ফিরে আসা জেলেদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি আমার ছেলেসহ নিখোঁজ জেলেরা বেঁচে আছে। এ ব্যাপারে ট্রলার মালিকদের কাছে বার বার সহযোগিতা চেয়েও সাড়া পাচ্ছি না। এদিকে জেলেদের উদ্ধার দাবীতে স্বজনরা মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বিভিন্ন দপ্তরে। কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর আক্তার কামাল বলেন, ৭৪ জন জেলে নিখোঁজ হওয়ার পর দীর্ঘ একমাস পেরিয়ে গেলেও তাদের উদ্ধার না হওয়াটা সত্যি দু:খজনক। ট্রলার মালিক কামাল হোসেন বলেন, নিখোঁজ জেলেরা এ দেশের নাগরিক। তাঁরা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ। জেলেদের উদ্ধারের ব্যাপারে সচিবালয়ে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের তালিকাও দিয়েছি। অথচ তাঁদের উদ্ধারে কিছুই হচ্ছে না। ৭৪ জেলে নিখোঁজের বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অবহিত করার পরও হদিস মিলছে না দেখে জেলেদের ফিরে আসা নিয়ে ধোয়াশা সৃষ্টি হয়েছে স্বজনদের মধ্যে। একমাস ধরে উৎকণ্ঠা ও অভাব অনটনে মানবেতর জীবন-যাপন করছে নিখোঁজ জেলে পরিবারগুলো। চলছে স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাদ। কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক ও কুতুবদিয়া পাড়ার ওসব জেলে কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানে না। বোট মালিক সমিতি ও জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসস সূত্র জানান, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে নিখোঁজ জেলেদের তালিকা সংগ্রহ করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। ৭৪ জেলে নিখোঁজ বিষয়ে খোঁজ নিতে নৌবাহিনীকে অবগত করা হয়েছে। নিখোঁজ ৭৪ জেলে ॥ গত ৬ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় নাডা’র কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাওয়া নিখোঁজ জেলেরা হলেন স্থানীয় আবুল হোসেন বহদ্দারের মালিকানাধীন এফবি সুমি আকতার রেশমী ফিশিং ট্রলারে থাকা মিনহাজ উদ্দিন মাঝি, মানিক, আলী হোসেন, নুরুল ইসলাম, নুর বাদশা, আতা এলাহী, আনোয়ার, আমির হোসেন, মোহাম্মদ উল্লাহ, ইলিয়াছ, নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ হোসেন, আব্দুল আমিন, নুরুল আলম, মজিবুর রহমান, এরফান, নুরুজ্জামান, ছিদ্দিক, লোকমান, মাহবুব আলম, রবি আলম, মো: হোসেন, সাইফুল, মামুন, আবুল কালাম, মকছুদ। এফবি সাজ্জাদ ফিশিং ট্রলারে থাকা মাঝিমাল্লারা হলেন ছৈয়দ মাঝি, জামাল, নুরুল বশর, আরফান, আতিকুর রহমান, মামুন, শাহিন, ছৈয়দ, আব্দু শুক্কুর, মো: গুন্নু, আজম, দুদুমিয়া, মিন্টু, সেলিম, এরশাদ, মো: নুর, মুসলেহ উদ্দিন, মন্জুর, বাবু মিয়া, আব্দুল মজিদ, শাহাদাতুল করিম, সোনা মিয়া, হারুন, ইসমাইল, ইউনুচ, নুর কাদের ও দেলোয়ার। এফবি জায়েদ ফিশিং ট্রলারে থাকা জেলেরা হলেন মোক্তার মাঝি, মোহাম্মদ রুবেল, আবু হানিফ, আব্দুর রহিম, শফি আলম, মো: লেডু, সিরাজ, ছাদেক, আক্তার, রুহুল আমিন, আজিজুল হক মো: হামিদ, সাদ্দাম হোসেন, মোহাম্মদ রুহুল আমিন ও করিম।
×