ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

মহান বিপ্লবীর অজানা গল্প

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

মহান বিপ্লবীর অজানা গল্প

সময় রাত দশটা। ২৫ নবেম্বর, শুক্রবার। মাধ্যম কিউবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। রাউল ক্যাস্ট্রো বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানালেন তার নেতা, বিশ্বজুড়ে অগণিত মুক্তিকামী মানুষের নিশ্বাসে বয়ে চলা নাম ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মাটির পৃথিবীতে তার শেষ শ্বাসটি গ্রহণ করেছেন। কানে ভেসে এলো ইতিহাসের আর্তচিৎকার। ইতিহাস যে তার বিপ্লবের বরপুত্রকে হারিয়েছে। অতঃপর নীরবতা। রাজনীতিতে প্রবেশ ১৯৪৭-এ ছাত্রাবস্থাতেই যোগ দেন ‘পার্টি অব দি কিউবান পিপলস এ’- যা তার প্রথম সংগঠন। তবে সে পার্টি নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারেননি। পার্টি নেতা এদুয়ার্দ চিবাস অজানা কারণে আত্মহত্যা করেন। ক্যাস্ট্রো নিজেও মতাদর্শিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন অন্য নেতাদের সঙ্গে। প্রথম নির্বাচন ‘পার্টি অব দি কিউবান পিপলস’-এর হয়ে ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। পার্টি যখন ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে তখন নির্বাচন বাতিল করে সামরিক আইনে ক্ষমতা গ্রহণ বাতিস্তা। ভিন্ন পথে ফিদেল ক্যাস্ট্রো মূল উদ্যোক্তা হয়ে ৫২তেই গঠন করেন অর্থোডক্স এবং পিএসসি কমিউনিস্ট মিলে ‘দি মুভমেন্ট’ নামে জোট। যদিও সচেতনভাবেই তিনি তার কর্মীদের কমিউনিস্ট কাছ থেকে দূরে রাখতেন। বরং ভাই রাউল ছিলেন তাদের কাছাকাছি। প্রথম কর্মী বাহিনী ও পদচারণা ১৯৫২-এর জুলাই থেকে পরবর্তী এক বছরে প্রায় ১২০০ কর্মী সংগ্রহ করেন এবং চষে বেড়ান সারা কিউবা। প্রথম সশস্ত্র আঘাত ও গ্রেফতার ১৬৫ দুর্দান্ত সাহসী সহযোদ্ধা নিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই আঘাত হানেন জান্ডা বাতিস্তার সুরক্ষিত মনকাডা সামরিক ব্যারাকে। কিন্তু শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। বিচারের সম্মুখীন হন মাত্র ২৫ জন সহযোদ্ধাসহ। বিচার ও নতুন বক্তা ফিদেল শুরু হয় বিচার। নিজের পক্ষ সমর্থনে ফিদেল তার যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তা সেখানে উপস্থিত ছয় জন সাংবাদিকের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যে বক্তব্য তাকে দেয় কিংবদন্তিতুল্য জনপ্রিয়তা। যা আজ সারাবিশ্বে পরিচিত- ‘ইতিহাস আমাকে দায় মুক্তি দেবে’ নামে। বিচারে তার ১৫ বছর কারাদ- হয় তাকে পাঠানো হয় পাইনস দ্বীপের কারাগারে। ক্যাস্ট্রোকে হত্যার প্রথম চেষ্টা অসংখ্যা হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া ক্যাস্ট্রোকে প্রথম চেষ্টা তার স্বদেশী জান্তা ব্যাটিস্টা কর্তৃক। তাকে বিষ দিয়ে হত্যার এক ষড়যন্ত্র জনসম্মুখে ফাঁস করে দেন ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ার। যার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ক্যাস্ট্রোকে বিষ দিয়ে হত্যার। এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়ার অপরাধে ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে কুলজেন্সি ব্যাটিস্টা সরকার। তবে দু’বছরের মাথায় ক্যাস্ট্রোকে কারা মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। মেক্সিকো, ২৬ জুলাই আন্দোলন ও চে কারামুক্তির পর গোপনে দেশত্যাগ করে মেক্সিকো চলে যান ক্যাস্ট্রো, মনকাডা আক্রমণের দিনটির স্মরণে ও ব্যাটিস্টা উৎখাতের জন্য ৫৪ সালেই ক্যাস্ট্রো গঠন করেন। ২৬ জুলাই আন্দোলন যা ইতিহাসে পরিচিত জুলাই টুয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট নামে। ক্যাস্ট্রো নামটির সঙ্গে চে-২৬ জুলাই আন্দোলনের কিছু পলাতক কর্মীর মাধ্যমে পরিচিত হন গুয়েতেমালায় অবস্থানকালে। মেক্সিকো অবস্থানকালে পরিচয় ও এক ইতিহাসের সূত্রপাত্র। ক্যাস্ট্রো-চে’র পরিচয়ের সেই দিন জেল মুক্তির পর ১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই মেক্সিকো নগরীতে পৌঁছেন ক্যাস্ট্রো। এর মধ্যেই নিকোলোপেজের মাধ্যমে চে’ পরিচিত হয়ে ওঠেন রাউল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে। ক্যাস্ট্রো মেক্সিকো পৌঁছার ২দিন পর রাউলের মাধ্যমে পরিচিত হন চে গুয়েভারার সঙ্গে। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, গ্রেফতার মুক্তি পরিচয়ের পর মেক্সিকো সিটির বাইরে ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে চেসহ গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন ক্যাস্ট্রো। পুলিশ খবর পেয়ে গ্রেফতার করে ক্যাস্ট্রো চেসহ আরও কিছু গেরিলাকে। ক্যাস্ট্রো সাতদিন ও চে ৫৭ দিন পর মুক্তি পান বন্দী শিবির থেকে। আবার প্রিয় স্বদেশ ও মুক্তির সংগ্রাম ৬৩ ফুট লম্বা, সাত কেবিনেটের এক নৌকা গ্রানমায় চড়ে ১৯৫৬ সালের ২৫ নবেম্বর মেক্সিকো উপসাগরের ট্যাক্সপাল থেকে ৬ হাজার ফুট উচ্চতার সিয়েরা মায়েস্তার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন ক্যাস্ট্রো। পৌঁছতে সময় লাগার কথা ৫ দিন। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ২দিন বেশি লাগে। খবর পেয়ে বাতিস্তা সরকার পৌঁছা মাত্রই শুরু করে গুলিবর্ষণ : চে বুকে-গলায় গুলিবিদ্ধ হন, ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ৮২ জনের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ১৫ মতান্তরে ২২ জন। মৃত্যুর গুজব হাভানা বিজয় ও রাষ্ট্রনায়ক সিয়েরা মারেস্ত্রা পাহাড়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গঠিত ৩০০ সদস্যের গেরিলা দল বাতিস্তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাতিস্তার সরাসরি নির্দেশ ছিল ক্যাস্ট্রোকে হত্যার। সামরিক বাহিনী ক্যাস্ট্রোর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে দেয়। নিউইয়র্ক টাইমসের হারবার্ট, এল, ম্যাজুজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে পৃথিবী জানতে পারে তিনি জীবিত। ম্যাথুজ লেখেন, যা প্রকাশিত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭তে। তিনি একজন শান্ত, ধীর, স্থির মানুষ। ভরাট মুখ, জলপাই রঙের ত্বক আর ছয় ফুট উচ্চতার এক প্রখর ব্যক্তিত্ববান মানুষ। সঙ্গে দৃষ্টি কেড়ে নেয়া দাড়ি। ক্যাস্ট্রো একের পর এক শহর দখলে নেন। ১৯৫৯ নতুন বছরের প্রথম দিবসে মধ্যরাতে বাতিস্তা পালিয়ে যান হাভানা ছেড়ে। ক্যাস্ট্রো নিয়ন্ত্রণে নেন দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ‘সান্তিয়াগো ডু’। অতঃপর ৮ জানুয়ারি হাভানায় প্রবেশ বিজয়ী বীরের। ক্যাস্ট্রোকে প্রথম অনুমোদন সারা বিশ্বকে অবাক করে ক্যাস্ট্রোর সরকারকে প্রথম অভিনন্দন জানায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর ১৯৫৯ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্বকে চমকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ক্যাস্ট্রো। প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার তাকে নিউ জার্সির গর্ডনেবের বাড়িতে রাখা নিরাপদ মনে করেন। ছিলেন ১৫ দিন। সেন্ট্রাল পার্কের এক জনসভায় ৬০ হাজার শ্রোতার সম্মুখে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তবে প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার দেখা না করে সে দায়িত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওপর। কমিউনিজমের পথে ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে ২৬ জুলাই মুভমেন্ট, বোকার পপুলার সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং রেভিলিউশনারি ডিরেক্টরি মার্চ ১৩ মিলিত হয়ে গঠন করে ‘সম্মিলিত বিপ্লবী সংগঠন’। ১৯৬১-এর ৩ অক্টোবর নাম পরিবর্তন করে ঘোষণা করা হয়। ‘কিউবান কমিউনিস্ট পার্টি’ ২ ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে প্রকাশ্য ঘোষণা দেন- আমি মার্কস লেনিনপন্থী। কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছিল ১৬ এপ্রিল ১৯৬১ সালে। হত্যা চেষ্টা ও বেঁচে যাওয়া তাকে হত্যার ৬৩৮টি ব্যর্থ প্রচেষ্টার অধিকাংশই নিশ্চিত করেছে সিআইএর গোপন ফাইল। ফরিন এসকালান্ডে যিনি ছিলেন ক্যাস্ট্রোর নিরাপত্তার দায়িত্বে হিসেব করে দেখিয়েছেন তা যেমন- আইজেন হাওয়ারের সময় ৩৮ বার কেনেডি, ৪২ বার জনসন, ৭২ বার নিক্সন, ১৮৪ বার কার্টার, ৬৪ বার রিগান, ১৯৭ বার বুশ সিনিয়র ১৬ ও ক্লিনটন ২১ বার। অলিম্পিক পদক ক্যাস্ট্রো একবার বলেছিলেন, যদি হত্যার ছক থেকে বেঁচে যাওয়ার জন্য অলিম্পিকে কোন পদক থাকত, তবে আমি পেতাম সোনার পদক। ক্যাস্ট্রোকে লেখা চে’র বিদায়ী চিঠি-তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম আনুষ্ঠানিকভাবে যা যা করার আমি তা করেছি। কোন আইনীই আর আমাকে কিউবায় বেঁধে রাখতে পারবে না। শুরু একটা অদৃশ্য বন্ধন... তোমার সঙ্গে আমাকে চিরকালের জন্যই বেঁধে দিয়েছে। যা ভাঙ্গা যায় না- যাবে না। সে বাঁধন কোন দলীয় বা সরকারী পদের নয়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সিয়েরা মায়েস্তের পাহাড়ের দিনগুলো থেকেই আমি তোমার ওপর তেমন করে ভরসা রাখতে পারিনি। বুঝে উঠতে পারিনি নেতা ও বিপ্লবী হিসেবে তোমার গুণগুলো... বলতে লজ্জা নেই, আমি সব সময়ই তোমাকে অনুসরণ করেছি। আর সে জন্য আমি গর্বিত। সে অর্থে আমি পথিক ছিলাম তোমার পথের।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দেয়া বয়ান জন এফ কেনেডি ২ মে ১৯৬১ সালের মে দিবসের সমাবেশে ক্যাস্ট্রো জানিয়ে দেন, আমরা যেমন মার্কিন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করি না তেমনি কেনেডি তোমার পরামর্শের কোন প্রয়োজন আমি বোধ করি না। রোনাল্ড রিগ্যান রোনাল্ড রিগ্যান তাকে স্বৈরশাসক বলায় প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, যদি ডিক্রি জারির মাধ্যমে রাষ্ট্র শাসনকে স্বৈরশাসন বলা হয় তাহলে পোপকেও তা বলা যায়। আরও বলেন, আর পৃথিবীকে আণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে নেয়ার অগণতান্ত্রিক ক্ষমতাধারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট না আমি বড় স্বৈরাচার তা আপনারাই বলবেন। জর্জ ডব্লিউ বুশকে স্বপ্নের মৃত্যু নেই- বুশ বলেছিলেন আমি ক্যাস্ট্রোর তিরোধানের অপেক্ষায় আছি। উত্তরে ক্যাস্ট্রো মে ২৮, ২০০৭-এ লেখেন, মনকাডা ব্যারাকে হামলার পর আমি যখন গ্রেফতার হই বাতিস্তার উত্তেজিত সৈন্যরা বার বার বন্দুক তাক করেছিল আমাদের দিকে। এর মাঝেই তাদের এক কালো লেফটেন্যান্ট চিৎকার করছিল- স্বপ্নের মৃত্যু নেই! এই শব্দগুলো আমি উৎসর্গ করলাম জর্জ ডব্লিউ বুশকে! ভবিষ্যতবক্তা ক্যাস্ট্রো! মনকাডা অভিযানে গ্রেফতার হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়ে ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন- ইতিহাসে আমার নাম লেখা রবে। ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৭৩ সালে একবার বলেছিলেন, আমেরিকা সেদিন কিউবার সঙ্গে কথা বলবে। যেদিন তাদের প্রেসিডেন্ট হবেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তার জমানায় ১১ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা প্রথম হাভানা সফর করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ক্যাস্ট্রো ১৯৭৩ আলজেরিয়ায় ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত ক্যাস্ট্রোর। ক্যাস্ট্রো বলেন, হিমালয় আমি দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বের বিভায় এই মানুষটি হিমালয়সম, তাকে দেখা আর হিমালয় দেখা এক কথা। থেমে গেছে মহাপ্রাণ- কমানদান্তে ফিদেল ক্যাস্ট্রো। সান্তিয়াগো ডুতে সমাহিত ডিসেম্বর ৪-এ। যেখান থেকে তিনি স্বপ্ন ছড়িয়ে দেবেন অনাগত প্রজন্মের মাঝে। তিনিই তো বলে গেছেন- স্বপ্নের মৃত্যু নেই।
×