ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নসম উচ্চতায় যে নারীরা

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

স্বপ্নসম উচ্চতায় যে নারীরা

দূর থেকে কেউ আকাশ দেখে তৃপ্ত হয়। কেউ সেই আকাশ ছোঁয়ার জন্য যেতে চায় খুব কাছাকাছি। মেঘের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আকাশের বুকে মাথা রেখে শুনতে চায় মহাকাশের গর্জন। কিন্তু সমতলে দাঁড়িয়ে কি সেই আকাশছোঁয়া সত্যিই সম্ভব? বিশেষ করে তাদের জন্য, যাদের দিকে সবসময় তাকিয়ে আছে সমাজের কড়া চোখ। কিছু করতে গেলেই ‘না’ শোনা যাদের অভ্যাস, যাদের চলাফেরায় নানা রীতি আর নিয়ম- সেই নারীদের পক্ষে কি আদৌ আকাশ ছোঁয়ার সাধ পোষা যৌক্তিক? এসব ভাবনার রাজ্য যখন মাথার ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছিল, তখনই বাংলাদেশের মেয়েরা জয় করে নিল এভারেস্ট শৃঙ্গ। নিশাত মজুমদার, আটপৌড়ে যে মেয়েটিকে হয়ত আগে কেউ খেয়ালও করেনি। হয়ত তার মাঝে মাঝে অফিসের কাজে দেরি করে বাড়িতে ফেরা পাড়ার লোকের গল্পের বিষয় ছিল, সেই মেয়েটি আজ শুধু পাড়া নয়, গোটা দেশের গর্বের বিষয়। বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্ট বিজয়ী। নিশাত মজুমদার সেই নারী, যে নারী প্রমাণ করেছে ‘না’ শব্দটি থেকে ‘নারী’ অনেক বেশি শক্তিশালী। ২০১২ সালে নিশাত মজুমদারের সেই অভূতপূর্ব জয়ের পর বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণীর মনে জেগে উঠে পাহাড় জয়ের সাধ। বিশেষ করে সেইসব মেয়েরা এগিয়ে আসে, যাদের স্বপ্ন দেখাটাই ছিল পাহাড় সমান বাধায় আটকে থাকা। আকাশের কাছাকাছি গিয়ে, মেঘের উপরে দাঁড়িয়ে দেশের পতাকা মেলে ধরার সাহস এবং অদম্য ইচ্ছা প্রতিটি নারীর মাঝেই আছে। সেই সাহসকে সামনে নিয়ে আসতে চাই একটু অনুপ্রেরণা, একটু প্রশ্রয়। যে প্রশ্রয় নিয়ে নারীর পাশে সবসময় আছে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন। নারীর আত্মবিশ্বাস কোন ছেলেখেলা নয়। আত্মবিশ্বাস কেবল চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে প্রমাণেরও নয়। নারীর আত্মবিশ্বাস তাকে নিয়ে যেতে পারে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে বিজয়ীর বেশে, আবার তুলতে পারে হাজার হাজার ফুট ওপরে মেঘের দেশে। তাই নারীর এই আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করতে ২০০৩ সাল থেকে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্কলারশিপ প্রোগ্রাম, নার্সদের জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রাম, এ্যাডুকেশন প্রোগ্রাম, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং প্রোগ্রাম, জার্নালিস্ট ট্রেনিং প্রোগ্রাম, বিউটি পার্লার ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং প্রোগ্রাম, ভোকেশনাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম ইত্যাদি কর্মসূচী বিভিন্ন সময়ে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশজুড়ে পরিচালিত হয়। ২০১৫ সাল থেকে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন আরও বড় পরিসরে নিজেকে সাজিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় নারীদের এই পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়ে নারীদের অগ্রযাত্রার সঙ্গী হয়েছে এই ফাউন্ডেশন। এগিয়ে যাওয়ার এই যাত্রায় ¯পন্সর হয়ে পাঁচ নারীকে পাহাড়জয়ে অনুপ্রাণিত করেছে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশের পাহাড়ে এবং হিমালয়ে ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর বাংলাদেশের পাঁচ নারীর একটি দল ভারতের উত্তর কাশীতে নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনিয়ারিং-এ ২৮ দিনের মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই পাঁচ নারী নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনিয়ারিং-এ প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ভারতের বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতে সফলভাবে আরোহণের মাধ্যমে তাদের যোগ্যতা প্রদর্শনে সক্ষম হন। প্রশিক্ষণার্থীরা হলেন, ইফফাত ফারহানা, ফৌজিয়া আহমেদ, শায়লা পারভীন, বিবি খাদিজা ও রেশমা নাহার। তাদের গল্পই বলে দেয় তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা। পাহাড় জয়ের সাধ নিয়ে ইফফাত ফারহানা জানান, ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদারকে দেখে তার আগ্রহের শুরু। চার বছর আগে ইফফাত বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং এ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য হন। তখন নারীদের আরও সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য এভারেস্ট জয়ী এম এ মুহিত পাহাড়ে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ইফফাত বলেন, যে কোন পর্বতারোহণের জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। সে লক্ষ্যেই আমরা রমনা পার্কে নানা শারীরিক চর্চা শুরু করি। ল্যাডার ক্রসিং, ক্রেভাস ক্রসিংসহ নানা প্রশিক্ষণ আমরা নিয়েছি। আমি বলব, আমাকে বাবা-মা যে পরিমাণ স্বাধীনতা দিয়েছেন তা বাংলাদেশের খুব কম মেয়েই পায়। তাদের মানসিক সমর্থন আমাকে এই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছে। ফৌজিয়া আহমেদ জানান, বিভিন্ন সময় বেড়াতে গিয়ে যখন পাহাড় দেখেছি তখন থেকেই এসব পাহাড় জয়ের শখ আমার। তাই বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং এ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য হই। আমাদের প্রশিক্ষণে ৯২ জন অংশ নিই, তার মধ্যে ৮৫ জন প্রশিক্ষণ স¤পূর্ণ করি। আমরা বাংলাদেশ থেকে পাঁচ নারী পাঁচ গ্রুপে ছিলাম। গত বছর আমরা কেওক্রেডাং-এ গিয়েছিলাম। এ বছর এই প্রশিক্ষণের আগে ১ মাসের প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। ২৫ কেজি বোঝা নিয়ে পাহাড়ে ট্রেকিংসহ আরও নানা ধরনের প্রশিক্ষণ আমরা সম্পন্ন করেছি। পর্বতারোহণের এ বীজ যদি স্কুল থেকে আমাদের মনে বপন করা যায়, তবে পর্বতারোহণে নারীদের অংশগ্রহণের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। পর্বতারোহণ আমাকে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করেছে। আমি মনে করি, এ ধরনের প্রশিক্ষণ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেও সাহায্য করে। স্পন্সরের কথা প্রসঙ্গে ফৌজিয়া জানান, এসব ব্যাপারে স্পন্সর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন আমাদের এই অভিযানের আর্থিক সহায়তা দেয়। আমি যতটুকু জানি, ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন নারীকে তার স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে অনেক বছর ধরে কাজ করছে। এছাড়াও নারীদের মেধা, যোগ্যতা ও কর্মপরিচালনা বিচারে স্কলারশিপ, কারিগরি শিক্ষা সহায়তা এবং ব্যবসার মূলধন প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এদেশে এমন আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। শায়লা পারভীন বীথির পাহাড়ে উঠার গল্প শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। বীথি জানান, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্ধুদের সঙ্গে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যাই। সেটা ছিল আমার প্রথম পাহাড়ে ওঠা। সেখানে পরিচয় হয় বাংলাদেশের প্রথম পর্বত আরোহণ ক্লাব বিএমটিসির সভাপতি ও দু’বারের এভারেস্ট বিজয়ী এমএ মুহিত ভাইসহ অন্য সদস্যদের সঙ্গে। এরপর থেকে বিএমটিসির সদস্যদের সঙ্গে সখ্য বাড়তে থাকে এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। পরে ক্লাবের সদস্য হই। আসলে পর্বত আরোহী হওয়ার স্বপ্ন আমি আগে দেখিনি। বিএমটিসিতে যোগ দেয়ার পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে নেপালে হিমালয়ের ২০ হাজার ২৯৫ ফুট উঁচু ‘কেয়াজো-রি’ শিখর অভিযানে আমাকে ও ফৌজিয়া আহমেদকে বেস-ক্যা¤প দলে নেয়া হয়। সে অভিযানে আমি খুব ভালভাবে ১৫ হাজার ৫০০ ফুট পর্যন্ত আরোহণ করি। সেখান থেকেই আমার স্বপ্নের শুরু। বিবি খাদিজা স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি স্বপ্নপূরণ এবং সেই অর্জন দিয়ে আশপাশের সবাইকে অনুপ্রাণিত করতেই জয় করতে চান সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। খাদিজা বলেন, আমাদের দেশে অনেক মেয়েরই স্বপ্ন থাকে চ্যালেঞ্জিং কাজ করার, কিন্তু সাহস, সামর্থ্য ও প্রয়োজনীয় সুযোগের অভাবে করতে পারে না। এটা ভেবে ভাল লাগে যে, আমরা প্রমাণ করেছি, স্বপ্ন দেখলে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই। আমার স্বপ্ন, মানুষের জন্য এমন কিছু করা, যাতে আমি পৃথিবী থেকে চলে গেলেও আমার কাজ থেকে যায়। রেশমা নাহারও কিছুটা খাদিজার মতোই স্বপ্ন ও বাস্তবতা দিয়ে নিজের অর্জনকে একটা মানদ-ে দাঁড় করাতে চান। তাই প্রশিক্ষণে ছিলেন মনোযোগী। রেশমা জানান, পুরো প্রশিক্ষণটাই জীবনে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেনিং হতো। পিঠের ওপর ২৫ কেজি ওজনের ভারি ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা সত্যি কষ্টের কাজ ছিল। হার মানিনি। চোট পেয়েও আত্মবিশ্বাস নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছি। প্রশিক্ষণ থেকে আমরা শুধু পর্বত বেয়ে ওপরে ওঠাই শিখিনি, ধৈর্যের সঙ্গে কীভাবে কাজ করতে হয় তাও শিখেছি। পর্বত আরোহণ করতে হলে প্রথমেই শারীরিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। মানসিকভাবে খুব শক্ত হতে হবে এবং সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া দক্ষতা আসবে না। তাই কম করে হলেও মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জরুরী বলে জানালেন এই পাঁচ আত্মবিশ্বাসী নারী। আত্মবিশ্বাসের কারণেই আজ তারা স্বপ্ন দেখছেন নিশাত বা ওয়াসফিয়ার মতো বাংলাদেশে পর্বতজয়ের গৌরব বয়ে আনার। যেন ঘরে ঘরে ‘না’ নয়, শোনা যায় ‘নারী’-র বিজয়ের গল্প। অপরাজিতা ডেস্ক
×