ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালী বীরের জাতি। সময়ের প্রয়োজনে লড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম। একেবারে সাধারণ কৃষক শ্রমিক থেকে শুরু করে নৌকার মাঝি- সবাই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। অভাবনীয় জনযুদ্ধে লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায় পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে কাক্সিক্ষত বিজয়। নিজের দেশটি বুঝে পাওয়ার যে আনন্দ আজও অমলিন। ডিসেম্বর আসলে দারুণ আবেগে ভাসে বাংলার মানুষ। এখন সেই সময়। মাসের প্রথম সপ্তাহেই নতুন চেহারা পেয়েছে রাজধানী ঢাকা। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয় দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো যারপরনাই ব্যস্ত। বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে দিন-রাত কাজ হচ্ছে। এভাবে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা হয়ে উঠেছে আনন্দনগরী। বিজয় দিবসের কথা সবার আগে স্মরণ করিয়ে দেয় জাতীয় পতাকা। শহরের সর্বত্র এখন লাল-সবুজের ঢেউ। পতাকা শোভিত ঝা-া কাঁধে নিয়ে অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছেন বিক্রেতারা। শহরের সব অলি গলিতে তাদের উপস্থিতি। বৃহস্পতিবার বিকেলে হাতিরপুলের মূল রাস্তার পাশ দিয়ে যানজট ঠেলে হেঁটে যাচ্ছিলেন শাহাদাত নামের এক বিক্রেতা। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘ক্রিকেট খেলার সময় পতাকা ভাল যায়। তার চেয়েও বেশি চলতাছে এই মাসে। অনেকেই গাড়িতে লাগায়। বাড়িতে নিয়া যায়। বাচ্চারা দেখলেও কিনে। এই কারণে বিক্রি ভাল।’ অন্য ব্যবসা রেখে পতাকা বিক্রি করা কেন? জানতে চাইলে মন ভাল করা উত্তর। বলেন, ‘ভাল লাগে ভাই। লাভ কম। তবু এইটাই করি। নিজের দেশের পতাকা তো ধরেন ভালই লাগে।’ কথা বলতে বলতে সামনের দিকে এগিয়ে যান বিক্রেতা। তার পিছু পিছু উড়ে চলে জাতীয় পতাকা। দেখে মনে পড়ে যায় সেই অমর সঙ্গীত- বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে...। বিজয় উৎসবের প্রস্তুতিটাও বেশ দৃশ্যমান। এবারও থাকছে অসংখ্য আয়োজন। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড। প্রতিবারের মতো এবারও এখানে থাকবে দেশের সবচেয়ে বড়, বর্ণাঢ্য এবং আকর্ষণীয় আয়োজন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সে লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম পদাদিক ডিভিশন। মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বর থেকে বিজয় সরণি আসার পথে বাম দিকে তাকালে উৎসব প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। বেশ কয়েকটি অস্থায়ী প্রবেশ পথ। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্মারক দিয়ে সাজানো। জানা যায়, ভেতরে এখন চলছে মহড়া। সেনা বিমান নৌবাহিনীর সদস্যরা পৃথক পৃথক মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন। বিজিবি পুলিশ আনসার র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীও মহড়ায় ব্যস্ত। আকাশের দিকে তাকাতে হয় না, শব্দই মনে করিয়ে দেয় বিজয় দিবসের বিশেষ মহড়া চলছে। কর্মসূচী চূড়ান্ত করেছে ঢাকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও। এবারও ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ১৩ ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শুরু। পরের দিন ১৪ ডিসেম্বর থেকে ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর ও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে উৎসব আয়োজন করা হবে। ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর দুই দিনের আয়োজন থাকবে পুরনো ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কে। ধনিয়াতে উৎসব হবে ৮ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। উত্তরা এবং মিরপুরেও বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করবে জোট। প্রতিবছরের মতো ১৬ ডিসেম্বর থাকবে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও চলছে প্রস্তুতি। বৃহস্পতিবার সেগুন বাগিচায় গিয়ে দেখা যায়, মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। কানে আসছিল পেরেক ঠোকার শব্দ। রাস্তার ধারে তৈরি করা হয়েছে লাল-সবুজর গেট। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচী উল্লেখ করা হয়েছে ডিজিটাল ব্যানারে। পাশেই দাঁড়িয়ে কাজ তদারকি করছিলেন জাদুঘরের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, শনিবার থেকে শুরু হবে ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানমালা। জাদুঘরের উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন থাকবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেলে আয়োজন করা হবে ‘মুক্তিযুদ্ধ : তারুণ্যের ভাবনা’ শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন। কবিতা নৃত্য সঙ্গীতের ভাষায় স্মরণ করা হবে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ বীরদের। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কথা বলবেন বুদ্ধিজীবীদের স্বজনরা। ১৬ ডিসেম্বর সকালে থাকবে শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণে আনন্দ আয়োজন। সন্ধ্যায় থাকবে সঙযাত্রা। এবার চলচ্চিত্রের কথা। এরই মাঝে জমে উঠেছে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎস। উৎসবের প্রতিদিনই দেখানো হচ্ছে দেশ-বিদেশের শর্ট ফিল্ম। মুগ্ধ হয়ে ছবি দেখেছেন দর্শক। উৎসবে মোট ১০৯টি দেশের ৫৫০টি চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে। ছয়টি ভেন্যুতে ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন ঢাকার দর্শক। শাহবাগের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন প্রধান ভেন্যু। এখানে উৎসবের আমেজটা টের পাওয়া যায়। পুরো প্রাঙ্গণ আয়োজকরা সাজিয়ে নিয়েছেন। ছবির প্রদর্শনী ছাড়াও চলছে গল্প আড্ডা। ভেতরে প্রতিদিন। প্রতিদিন চারটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল ১১টা থেকে শুরু। এরপর দুপুর ৩টা বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রদর্শনী। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনও শর্ট ফিল্মের। বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় দুটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একই ভবনের নিচতলায় সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে প্রতিদিন থাকছে তিনটি করে ছবি। দুপুর ৩টা, বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় ছবি দেখা যাচ্ছে। আরেকটি ভেন্যু শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত নৃত্য মিলনায়তন। এখানে দুপুর ৩টা, বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পুরনো ঢাকার দর্শক ছবি দেখছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে। প্রতিদিন তিনটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল ১০টা, দুপুর ১২টা ও দুপুর ২টায় ছবি দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ৮দিনব্যাপী আয়োজন শনিবার শেষ হবে।
×