ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গঠন করা হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ ;###;বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে

মানবসম্পদ উন্নয়নে এক ছাতার নিচে আনা হচ্ছে ২৩ মন্ত্রণালয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

মানবসম্পদ উন্নয়নে এক ছাতার নিচে আনা হচ্ছে ২৩ মন্ত্রণালয়

এম শাহজাহান ॥ মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে সরকারের ২৩ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা হচ্ছে। গঠন করা হচ্ছে মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে-দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসম্পদে পরিণত করা। বিশেষ করে দেশে এবং বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে দেয়া। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের রিয়াদে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভাড়া নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশটিতে কর্মরত অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে। এর ফলে শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি বেড়ে রেমিটেন্স বেশি আয় করা সম্ভব হবে। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করবে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্রমতে, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। চলতি বাজেটে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ঘোষণা রয়েছে সরকারের। এছাড়া আগামী বাজেটে মানব সম্পদ উন্নয়নে সবেচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। বর্তমান ২৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৩০টি সংস্থা মানব সম্পদ উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করছে। তবে মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগটি নিজে কোন প্রশিক্ষণ প্রদান করবে না। বরং অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে তার সমন্বয় সাধন, বাজারের চাহিদা মোতাবেক প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সনদের ব্যবস্থাকরণ, দেশ-বিদেশের চাহিদা নিরূপণ, কর্মসংস্থান ও দক্ষতার ব্যবধান পরিমাপ করা ও সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের মান নির্ধারণসহ বিভিন্ন কাজ করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত এ বিভাগ সরকারের ২৩ মন্ত্রণালয়-বিভাগের করা এ সংক্রান্ত কাজের সমন্বয় সাধন করবে। এটি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গঠিত ‘ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের (এনএসডিসি) সার্বিক নির্দেশনায় পরিচালিত হবে এবং এনএসডিসি সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করবে। আর দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য নিরবচ্ছিন্ন অর্থায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের অধীনে ন্যাশনাল হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এনএইচআরডিএফ) গঠন করা হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে ২৩টি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট ৩০টি সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম-কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। তারা কে কী কাজ করছে তার মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। এজন্য সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের যেখানে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন, সেখানেই প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে এবং সেজন্য সার্বিক দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনটি প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে গঠন করা হবে। নতুন বিভাগটি নিজে কোন প্রশিক্ষণ প্রদান করবে না বরং অন্যান্য মন্ত্রণালয়-বিভাগ যে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে তার সমন্বয় সাধন, বাজারের চাহিদা মোতাবেক প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সনদের ব্যবস্থাকরণ, দেশ-বিদেশের চাহিদা নিরূপণ প্রভৃতি কাজ করবে। বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত যেসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৫ কোটি ৮৭ লাখ শ্রমশক্তি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে ব্যবস্থাপক, টেকনিশিয়ান, সহায়ক কর্মী, সেবা ও বিপণন কর্মী, কৃষি, বন ও মৎস্য খাতে দক্ষ কর্মী, কারুশিল্পে নিয়োজিত কর্মী, প্লান্ট ও মেশিন অপারেটর ও যন্ত্রাংশ সংযোজনকারী অন্যান্য প্রাথমিক পেশায় রয়েছেন। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত রয়েছেন ৭০ লাখের মতো বা বাংলাদেশি। এসব শ্রমিকের আয় বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়নে জরুরী হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের শ্রমশক্তির স্বল্প দক্ষতা উচ্চতর হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বল্প দক্ষতার কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি শ্রমশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পোশাক শিল্পের ন্যায় দ্রুত প্রসার লাভকারী খাতসমূহ দক্ষ শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপনায় দক্ষ পেশাজীবী কর্মীর সঙ্কটে ভুগছে। দক্ষ মানব সম্পদের অভাবে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে ৭০ লাখ লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত আছেন তার মধ্যে ৩১ শতাংশ দক্ষ, ১৪ শতাংশ অর্ধদক্ষ, ২ শতাংশ পেশাজীবী এবং ৫২ শতাংশ স্বল্প দক্ষ। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ার প্রেক্ষাপটে দক্ষ জনবল প্রেরণ করা হলে প্রবাসী আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। বিগত কয়েক বছরে দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থায় অগ্রগতি অর্জিত হলেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনে এখনও বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। জানা গেছে, রূপকল্প-২১ এবং এসডিজি বাস্তবায়নসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নে মানব সম্পদের দক্ষতা, জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে গত অর্থবছরের বাজেটেই মানব সম্পদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষ পরিচালনার জন্য জাতীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন তহবিল (এনএইচআরডিএফ) গঠন করে তাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দেরও প্রস্তাব করা হয়। নিরাপদ ও উন্নত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনই এ তহবিলের লক্ষ্য। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামষ্টিক অর্থনীতি অনু বিভাগের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ তহবিল গঠন করা হয়েছে। তহবিল গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ প্রাক-নিয়োগ ও কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং নারী, সুবিধাবঞ্চিত ও বেকার জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হবে এ তহবিল। এছাড়া প্রশিক্ষণ প্রদানকারীদের অর্থায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে এ তহবিল কাজ করবে। এতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শক্তিশালী হবে, বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে, শিক্ষা ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সঙ্গে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।
×