ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পাকিদের স্বাধীনতা দিবস পালনের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায়

বগুড়ায় ডাঃ আরশাদরা বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেন পাওয়ার স্টেশন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

বগুড়ায় ডাঃ আরশাদরা বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেন পাওয়ার স্টেশন

সমুদ্র হক ॥ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারে মুক্তিযুদ্ধের গর্বে আমরাই শ্রেষ্ঠ। ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র কয় মাসের ট্রেনিংয়ে যুদ্ধে নেমে তাদের পরাভূত করে বাংলার তরুণ দামাল ছেলেরা। বীর মুক্তিযোদ্ধারা কখনও গেরিলা যুদ্ধ কখনও আকস্মিক হানাদারদের কবলে পড়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় সম্মুখ সমরে নেমেও বিজয়ী হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকস্তানী বাহিনীকে এই দেশে তাদের (পাকিস্তানের) স্বাধীনতা দিবস (১৪ আগস্ট) পালন করতে দেয়নি। ওদিন বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে পাক সেনাদের ছাউনি ও পাওয়ার স্টেশন। এমনই বীরত্বগাথার মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুস সালাম। ফ্রিডম ফাইটার (এফএফ নম্বর ১৭৪), বর্তমান সনদ ১৯১২২৫। বয়স ৬৬ পেরিয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি সরকারী আজিজুল হক কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী। জুনে ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমে পড়েন। যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি উপজেলার বলাইল গ্রামে তার বাড়ি। দলখদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কবল থেকে দেশ মুক্ত করতে কয়েক তরুণ মিলে যমুনা পাড়ি দিয়ে চলে যান ভারতের মানিকারচরে। সেখানে রিক্রুট হচ্ছিল মুক্তিবাহিনী। গেরিলা ইউনিটে ভর্তি হয়ে এ-উইংয়ে ট্রেনিং নেন শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ট্রেনিং শেষে ১৭ সদস্যের গেরিলা টিম গঠিত হয়। কমান্ডার হন শের আলী আর সেকেন্ড ইন কমান্ডের (টুআইসি) দায়িত্ব পান আবদুস সালাম। কুড়িগ্রামের রৌমারী হয়ে দেশে প্রবেশ করেন। গেরিলা কায়দায় যুদ্ধে সফল অপারেশনের পর খবর পান বগুড়ার গাবতলী এলাকায় হানাদার পাকিস্তানী সেনারা ঘাঁটি গেড়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ হত্যা করছে। নারীদের লাঞ্ছিত ও নির্যাতন করছে। দেখতে পান পাকিস্তানী সেনারা লঞ্চে নদীতীর ধরে যাওয়ার সময় নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে গ্রামের লোকদের হত্যা করছে। তখন তারা কৌশলে যুমনায় নেমে ডুব-সাঁতার দিয়ে তীরে উঠে পজিশন নেয়ার আগেই লঞ্চ চলে যায়। ওই ঘটনার পর ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে গেরিলা দলটি। নবেম্বরের প্রথম দিকে কামলা কিষানের ছদ্মবেশে তারা প্রবেশ করেন গাবতলীর গ্রামে। দুর্গাহাটার কাছে পাক হানাদার ক্যাম্প রেকি করার পর পরিকল্পনার ছক কষেন শের আলী। পরের দিনে দেখেন ১২-১৪ জনের সশস্ত্র পাক সেনা গ্রামে প্রবেশের জন্য পথে নেমেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক মিনিটের মধ্যে সমবেত করে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে জমির মধ্যে ক্যামোফ্লেজে এমনভাবে এ্যাম্বুশ করে কৌশলে অবস্থান নেয় যাতে দূর থেকে হাতের ইশারা দেখতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অতর্কিত একটি গ্রেনেড ছুড়েই পাক সেনাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই সরাসরি ফায়ার ওপেন করেই ক্রলিং করে খোলা পথ দিয়ে বের হয়ে ঘিরে ফেলে। লক্ষ্যভেদী ফায়ার করলে পাক সেনাদের ব্রাশফায়ার বিফলে যায়। জীবিত দুই পাক সেনা হাত উঁচিয়ে সারেন্ডার করলে পরাজিত সৈনিকদের বন্দী করে নৌকাযোগে সানন্দবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে কমান্ডারের হাতে তুলে দেন তারা। আব্দুস সালামের স্ত্রী ও তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে গর্বিত। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আরশাদ সায়ীদ ॥ বয়স প্রায় ৬৫। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাড়ি বগুড়ার সূত্রাপুরে। ভারতের তরঙ্গপুর ক্যাম্পে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে প্রবেশ করেন দেশে। অঙ্গীকার দেশকে মুক্ত করার। ৭ নম্বর সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন। প্রবাসী সরকারের নির্দেশে তিনিই (মেজর নাজমুল) মুক্তিযুদ্ধের তালিকা প্রণয়নে নাম লিপিবদ্ধ করেন। সেই ভলিউমে প্রথম নাম ছিল আহসান হাবিব ওয়ালেস, দ্বিতীয় নাম ডাঃ আরশাদ সায়ীদ। তালিকা অনুযায়ী ডাঃ আরশাদ দ্বিতীয়। সেক্টর কমান্ডার নাজমুল মুক্তিযুদ্ধকালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান। ’৭১-এর আগস্টে বগুড়ার সাবগ্রামে একটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর গ্রুপ কমান্ডার আহসান হাবিব ওয়ালেস সিদ্ধান্ত নেন বড় একটি সফল অপারেশনের। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। হানাদার পাকিস্তানীরা যেন ১৪ আগস্ট এই দেশে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে না পারে তার পরিকল্পনা করা হয়। ওই অপারেশনের দায়িত্ব বর্তায় আরশাদের ওপর। ঠিক হয় বগুড়া পাওয়ার হাউস থেকে যে মেন লাইন বের হয়ে গেছে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে তা উড়িয়ে দিলে একদিকে বগুড়া অন্ধকার থাকবে অপরদিকে পাক সেনাসহ লোকজন জানবে মুক্তিবাহিনী শহরে ঢুকেছে। পাকিস্তানীদের ১৪ আগস্টের অনুষ্ঠান প- হবে। অপারেশনটি অনেক বিপজ্জনক। পাওয়ার হাউসে পাক সেনাদের আছে শক্তিশালী পাহারা। চারদিকে সার্চলাইট। সামনে ট্যাঙ্ক। পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রুপ করে আরশাদ, নবেল ও সাইফুল বাজারের চটের ব্যাগের ভেতরে দরোজায় লাগানো পুডিংয়ের মতো এক্সপ্লোসিভ রেখে উপরে শাকসবজি দিয়ে ঢেকে রংমিস্ত্রির ছদ্মবেশে পথে নামেন। ব্যাগে আরও ছিল সামান্য কাপড়চোপড়, যা দিয়ে কৌশলে ঢেকে দেয়া হয় ডিনামাইট ও ডেটনেটর। গেরিলা কায়দায় কোমরে গামছায় বেঁধে রাখা হলো দুটো করে গ্রেনেড। শুরু হলো অপারেশন পাওয়ার হাউস। অনেকটা হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে রাত ৮টার দিকে বগুড়া শহরের এবড়ো-খেবড়ো পথ পেরিয়ে পাওয়ার হাউসের কাছাকাছি অবস্থানে গিয়ে দেখা গেল পাক সেনার এক কনভয় পার হচ্ছে। রাতের মেঘলা আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ টর্চের আলোয় চমকে ওঠে সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাওয়া গেল সামনে-পেছনে ১০-১২ জন পাকিস্তানী প্যারামিলিশিয়া বাহিনী। আরশাদদের বাড়িতে বিহারীরা ভাড়া থাকায় আধোভাঙ্গা উর্দু জানতেন। মিলিশিয়াদের প্রশ্নে ভাঙ্গা উর্দুতে বললেন তারা রংমিস্ত্রি। কাজ শেষে ফিরতে দেরি হয়েছে। বাজারের ব্যাগ দেখে ওরা মনে করল রংমিস্ত্রিই হবে। পাক সেনার কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ বসতে দিলে আরশাদ, নবেল ও সাইফুল ভাবলেন মারা তো পড়েছেনই বুদ্ধিমত্তায় শেষ চেষ্টা করে দেখা হোক। ওদের অবস্থানটি ঠিক পাওয়ার গ্রিডের মূল তারের কাছেই। কেবিন বক্স সেখানে। কোন দেরি না করেই এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে বের হওয়ার পথ দেখে নিয়েই সার্চলাইটের কন্ট্রোল প্যানেলে সরাসরি গ্রেনেড চার্জ করে কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভোঁ-দৌড় দিয়ে পাশের ডোবায় নেমে ক্রলিং করে বের হয়ে গেলেন। তখন পাওয়ার হাউসের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ পাওয়া গেল। অন্ধকারে পাক মিলিশিয়ারা ছুটোছুটি করতে থাকে। ততক্ষণে অপারেশন যা করার তা হয়ে গেছে। হানাদারদের অনুষ্ঠান আর হয়নি। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ বর্তমানে চিকিৎসক হিসেবে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ বগুড়া শহরে বাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধের গর্বভরা তাদের মুখ। এতকিছুর পরও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটে নাম লেখাতে পারেননি এখনও। প্রতিবারই বলা হয়েছে তরঙ্গপুর গেরিলা ক্যাম্পের খাতা পাওয়া যায়নি। কিছুদিন আগে বলা হয় ওই খাতা পাওয়া গেছে। নতুন নামের তালিকা চাওয়া হলে ডাঃ আরশাদ সায়ীদ আবেদন করেছেন। এখনও আশা করছেন জীবনের শেষের অধ্যায়ে জীবিতকালেই তার নামটি লেখা পড়বে সরকারী গেজেটে।
×