ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী

রাষ্ট্রপতি যেভাবে নির্বাচন কমিশন চাইবেন আমরা মেনে নেব

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

রাষ্ট্রপতি যেভাবে নির্বাচন কমিশন চাইবেন আমরা মেনে নেব

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির সব পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি আলোচনা করবেন, আলোচনার মাধ্যমে যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন চাইবেন, আমরা তা মেনে নেব। আমরা চাই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক, দেশের গনতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে অংশ না করার একটি দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। একটি দলের নেত্রী যদি নির্বাচনে না আসার ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তার খেসারত তাকেই দিতে হবে। দেশের জনগণ তার খেসারত দিতে হবে কেন? নির্বাচনে না এসে বিএনপি নেত্রী একটি ঘরে বসে থেকে হুকুম দিয়ে দিয়ে শত শত জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছেন। এভাবে এতগুলো মানুষকে কেন হত্যা করা হলো, কেন পুড়িয়ে মারলেন? এর জন্য অবশ্যই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। একই সঙ্গে চাইবো, যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, এ ব্যাপারে যে মামলাগুলো হয়েছে যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, জড়িতরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। দেশের মাটিতে কোন সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের স্থান হবে না, হতে দেব না। বৃহস্পতিবার রাতে দশম জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশনের সমাপনি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। হাঙ্গেরি যাত্রাপথে বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্দেহ করা হয় এটি কোন যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না, এটি মনুষ্যসৃষ্টি। যাদের কাছ থেকে বিমানগুলো কেনা হয়েছে তাদের ৬ হাজার প্লেন পৃথিবীতে চলছে। তাদের কোন প্লেনে এই ধরণের কোন যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনার তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। তিনি বলেন, আমি আমার কথা চিন্তা করি না, চিন্তা করেছি আমার সঙ্গে যারা ওই বিমানের যাত্রী ছিল। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি। জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের শক্তহাতে দমন করেছি। তাই আমি জানি আমার জীবন যে কোন সময় যেতে পারে। বিমানের স্ক্রু ঢিল করা হোক বা ডেবরি (কোন কিছুর ধ্বংসাবশেষ) রাখা হোক। কিন্তু সেটা নিয়ে আমি ভয় করি না। জীবন দেওয়ার ও নেওয়ার মালিক আল্লাহ। যতই ঘাত-প্রতিঘাত আসুক, হত্যার চেষ্টা করা হোক না কেন- যতদিন বেঁচে আছি, যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাব। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। ২১ আগস্টসহ বহুবার আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহই আমাকে হেফাজত করেছেন। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা দেখি বিএনপি ভোট কারচুপি ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলে। নির্বাচন কমিশন কিভাবে হবে সেটা নিয়েও তারা এখন অনেক শলা পরামর্শ দেয়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। সেই ১৯৭৮ সালের ‘হ্যা না’ ভোট অথবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বা ১৯৮৯ সালের সেই ভোট কারচুপি থেকে শুরু করে মাগুরা, মিরপুর ও ঢাকা-১০ এর উপ-নির্বাচনসহ প্রত্যেক নির্বাচনের চেহারা আমাদের দেখা আছে। তিনি বলেন,সব থেকে বড় কথা হচ্ছে খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। যে নির্বাচনে কয়েকটা দল অংশগ্রহন করেছিল? আর কত শতাংশ ভোট পড়েছিল? সমগ্র বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে খালেদা জিয়া নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন করেছিলেন। ভোট চুরি করেছিলেন বলেই কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছে, ৩০ মার্চ জনগণের আন্দোলনের রুদ্ধরোষে তাঁকে পদত্যাগে জনগণ বাধ্য করেছিল। এই কথাটা সে কী এখন ভুলে গেছেন? তিনি বলেন, ২০০১ সালে ১ অক্টোবর নির্বাচনে কিভাবে কারচুপি হয়েছিল সেটাও আমাদের জানা আছে? ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ে যে খেলা তারা খেলতে শুরু করেছিল, কাজেই এই ধরনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছেন তাদের মুখ থেকে অনেক পরামর্শ এখন শোনা যায় বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা নির্বাচনটা অবাধ হোক, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হোক সেটাই চাই। জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তো আমিই করেছি। আমরাই করেছি। তার জন্য আওয়ামী লীগের অনেক লোক জীবন দিয়েছে। আমরা চাই এই দেশে একটি গণতান্ত্রিক সুষ্ঠ ধারা অব্যাহত থাকুক। তাহলেই এই দেশের অর্থনৈতিক ত্বরান্বিত হবে। আর আওয়ামী লীগ যে উন্নতি হয় এটা তো দেশের মানুষই উপলব্ধি করছে। দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার না করে পুরস্কৃত করেছেন। আমরা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্ক ও অভিশাপ থেকে মুক্ত করছি। আমরা সংবিধান সংশোধন করে হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছি। এ প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ৫ বছরের শাসনামলে দুঃশাসন, দুর্নীতি, হাওয়া ভবন খুলে দুর্নীতির কেন্দ্র বানানো, বিদেশে অর্থপাচারসহ এহেন অনৈতিক কর্মকান্ড নেই যা করা হয়নি। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করেছে। আমরা সেই সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ কঠোর হস্তে দমন করেছি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। দুর্নীতি কেউ করলে রেহাই পাবে না, সরকার এতে হস্তক্ষেপ করবে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। তখন দরজা দিয়ে খুলে দিয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছিল। ১৬ কোটি মানুষের ছোট দেশ, এরপর এতো শরণার্থী দেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমার সরকারকে বলেছি এ ধরণের ঘটনা যাতে না ঘটে, তাদের নাগরিক যেন আমাদের দেশে আর না আসে। তারা যেন তাদের দেশের পরিস্থিতি শান্ত করেন। তিনি বলেন, যারা মিয়ানমার থেকে দেশে প্রবেশ করেছে, তাদের মানবতার খাতিরে তাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তবে আমিও বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে একমত যে, এ ঘটনায় বিশ্ব নেতারা এতো নিশ্চুপ কেন? আমরা চাই মিয়ানমারের পরিস্থিতি শান্ত হোক। তিনি বলেন, একটি গ্রুপ মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের ৯ সদস্যকে হত্যা ও সেনাবাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা থেকেই এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে। তাই যারা মিয়ানমার পুলিশকে হত্যার সঙ্গে জড়িত, তারা বাংলাদেশের মাটিতে আসতে না পারে। আমি গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছি, এসব খুনীরা যদি বাংলাদেশে পালিয়ে থাকে তবে খুঁজে বের করে মিয়ানমার পুলিশের হাতে তুলে দিতে। বাংলাদেশের মাটিতে কোন সন্ত্রাসদের স্থান হবে না। তাঁর সরকারের উন্নয়ন ও সফলতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বের অনেক নেতাই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন এতো উন্নয়নের পেছনে ম্যাজিকটা কী? উত্তরে বলেছি- এখানে কোন ম্যাজিক নেই, নিজেকে সম্পূর্ণ জনগণের কল্যাণে এবং মানুষের জন্য আন্তরিকভাবে নিয়োজিত করে কাজ করছি। এ কারণে আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই দেশের মানুষের কল্যাণ হয়, দেশের উন্নতি হয়। তিনি বলেন, আমরা এখন দেশের ৯০ ভাগ কাজ নিজের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছি। বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতায় থাকতে তাদের নীতিই ছিল বিদেশীদের কাছ থেকে হাত পেতে নেয়া, ভিক্ষা নিয়ে চলা। কিন্তু আমাদের সরকারের নীতি হচ্ছে কারোর কাছে হাত পেতে চলবো না, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদা নিয়ে চলবো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, দেশের একটি মানুষ গৃহহারা থাকবে না। আমাদের সামর্থ অনুযায়ী একটি ঘরও যদি কওে দিতে পারি, সেটা করে দেব্ সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যে জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না তাঁর (রওশন এরশাদ) এ বক্তব্য সঠিক নয়। বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিদেশী বিনিয়োগ বর্তমান সরকারের আমলে এসেছে এবং আসছে। বিনা বিচারে কারাগারে আটক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে কতজন বিনা বিচারে আটক রয়েছে, তাদের একটি তালিকা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি এবং তাদের বিচারকার্য যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয় সেই উদ্যোগও নিয়েছি। যারা শাস্তি পাওয়ার পাবে, যারা মুক্তি পাওয়ার পাবে। বিরোধী দলের নেতার প্লট না পাওয়ার অভিযোগের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমিও কোন প্লট পাইনি। ঢাকা শহরে আমার কোন নিজস্ব বাড়ি বা প্লট নেই। পৈত্রিক যে বাড়িটি ছিল তা আমরা দু’বোন জনগণের জন্য ট্রাস্টকে দিয়ে দিয়েছি। আমার দাদার বাড়ি আছে। গ্রামে জন্মেছি, শেষ সময়ে প্রয়োজনে গ্রামেই চলে যাব। আমি গ্রামে মানুষ হয়েছি, গ্রামেই থাকতে পছন্দ করি।
×