ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকে সুদহার সামান্য কমলেও ছোট ও নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের ভাগ্যে তা জুটছে না

বড়রাই সুবিধাভোগী

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

বড়রাই সুবিধাভোগী

রহিম শেখ ॥ বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। সেই বাধা ক্রমেই শিথিল হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঋণের সুদহার ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’ নামিয়ে আনার দাবি এবং বিদেশী ঋণ সহজলভ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো সুদহার কমাতে বাধ্য হচ্ছে। তবে নিম্নমুখী এ সুদহার হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকে সামান্য পরিমাণে কমলেও বেশিরভাগ ব্যাংকেই তা রয়ে গেছে উচ্চপর্যায়ে। আর কমতি সুদহারের যেটুকু সুবিধা রয়েছে তা ভোগ করছেন বড় বড় ব্যবসায়ীরাই। ছোট এবং নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের ভাগ্যে জুটছে না এমন সুবিধা। পরিসংখ্যান বলছে, ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্পকারখানার জন্য ব্যাংকগুলো মেয়াদী ঋণ বিতরণ করেছে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদে। আবার কোন কোন ব্যাংকের সর্বনিম্ন সুদহারের সিলিং হলো ১৪ শতাংশ, যা বড় উদ্যোক্তারাই পেয়ে থাকেন। তবে ছোট বা নতুন উদ্যোক্তাদের আরও বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এরপর রয়েছে নানা রকমের অদৃশ্যমান চার্জ। এতে করে ভাল উদ্যোক্তা হয়েও অনেকে পুঁজি হারাতে বসেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশেষায়িত বিডিবিএল ব্যাংক বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ১২-১৪ শতাংশে ঋণ দিলেও ছোট উদ্যোক্তাদের দেয়া হয় ১৩-১৪ শতাংশ সুদে। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করছে নতুন প্রজন্মের এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। ব্যাংকটি বড় উদ্যোক্তাদের ১৫-১৬ শতাংশ সুদে দিলেও ছোট শিল্প উদ্যোক্তাদের দেয় ১৫-১৮ শতাংশ সুদে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক বড়দের জন্য ১১-১৫ শতাংশে দিলেও ছোটদের দেয় সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। পুরাতন ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করলেও ছোট অর্থাৎ শুরুর পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করছে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ সুদে। ঢাকা ব্যাংক বড় উদ্যোক্তাকে ৯-১২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয় আর ছোট গ্রহীতাদের দেয় ১২ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশে। অর্থাৎ সবগুলো ব্যাংকের ক্ষেতেই নিম্নতম সুদহারের স্তরটি ব্যবহার করা হয় বড় বা পুরাতন শিল্প ব্যবসায়ীদের জন্য। আর উচ্চতর স্তরটি ব্যবহার করা হয় ছোট শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য। তারপরও বাড়ছে এসএমই ঋণ বিতরণ। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে এসএমই খাতে বিতরণ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবর শেষে ১৬টি ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের (স্প্রেড) সুদহার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত সীমার বাইরে রয়েছে। এ তালিকায় বেসরকারী খাতের ১০টি, বিদেশী খাতের ৬টি ব্যাংক রয়েছে। এদিকে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সময়ে সামান্যতম সুদহার কমিয়ে আমানতে সুদহার কমিয়ে এনেছে অর্ধেকেরও বেশি, যা বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কোন কোন ব্যাংক আমানত সংগ্রহে শূন্য শতাংশ আমানতে শূন্য শতাংশ সুদহারও অফার করছে গ্রাহকদের। ডাচ-বাংলা, ব্র্যাক ও আইসিবি আমানতে সর্বোচ্চ ৪-৫ শতাংশ সুদ প্রদান করলেও সর্বনিম্ন শূন্য শতাংশও অফার করছে গ্রাহককে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে সুদহারটা নির্ধারণ করে দিতে পারে না। তবে এটাকে প্রভাবিত করতে পারে। এর জন্য নানা ধরনের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল আছে। কৃষি ও এসএমইতে কিছু কিছু সহায়তা দেয়া হয়েছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়। আমাদের এ মুহূর্তে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন রুট লেভেলের উদ্যোক্তাদের তুলে আনতে সহযোগিতা করা। এজন্য ব্যাংকগুলোর উচিত নতুন শিল্পোদ্যোক্তা হলে তাদের কম সুদে বা একটু ছাড় দিয়ে ঋণ সহায়তা দেয়া। কিন্তু তারা সেটা না করে শুধু পরিচিত গ্রাহকদের কাছেই ঘুরঘুর করে। আর ১৪-১৮ শতাংশ সুদহার তো অতি উচ্চ। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। না হলে উপায় নেই, বিনিয়োগে প্রভাব পড়বেই। তবে ব্যাংকগুলো চেষ্টা করছে তাদের সুদহার কমিয়ে আনতে। যার প্রথম প্রদক্ষেপ হিসেবে আমানতে সুদহার কমিয়েছে। যদিও দুটোই সমানতালে কমানো উচিত ছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা মনে করেন। ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য জমে থাকার পরও কেন তারা কম সুদে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কিছু কিছু ব্যাংক মাত্রাতিরিক্ত প্রফিট টার্গেটে বেশি সুদে ঋণ বিতরণের জন্য বসে রয়েছেন। এজন্য তারা মন্দ গ্রাহককেও ডেকে এনে ঋণ দিতে রাজি। আর ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের বহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যার মাশুল ব্যাংকগুলোকে টানতে হচ্ছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির চেয়ারম্যান আনিস এ খান জনকণ্ঠকে বলেন, শিল্প ঋণের সুদহারের সর্বনিম্ন সীমা ১৪ শতাংশ এটা কোনভাবেই হওয়া উচিত নয়। এটা অতি মুনাফার লক্ষণ। আর এ বিষয়টা দেশের বিনিয়োগকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে ঋণ খেলাপের ঘটনাও ঘটছে। যদিও নতুন উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়া একটু রিস্ক রয়েছে তবুও তাদেরই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের উচ্চ সুদই এখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এরপরও অনেক বিনিয়োগকারী দেশের স্বার্থে শিল্প করার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। কিন্তু ঋণের চক্রবৃদ্ধি সুদ এত বেড়ে যায়; যা পরিশোধ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে হলে সার্বিকভাবে ব্যাংকঋণের সুদহার দ্রুত কমিয়ে আনার দাবি ব্যবসায়ী মহলের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, ৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিলে ব্যাংকের যথেষ্ট লাভ থাকে। তবুও ১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকের হিডেন কস্ট বা অদৃশ্য খরচ বেড়ে গেছে। ব্যাংকের লোন ডিপার্টমেন্টের টার্গেট দেয়া থাকে। তারা শুধু টার্গেট পূরণে ব্যস্ত। গ্রাহকের দিকটা তারা ভাবে না। বসে বসে উচ্চ সুদ গ্রহণ করে। তিনি বলেন, এক বছর আমার ব্যবসা বন্ধ ছিল। বন্ধ থাকার সময়েও ব্যাংককে ৯০ লাখ টাকা সুদ দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জনকণ্ঠকে বলেন, শিল্পেই যদি ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হয় তাহলে বিনিয়োগের গতি আসবে কিভাবে। আর সব উদ্যোক্তাই তো বিদেশী ঋণ সহজে নিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় রয়েছে ছোট শিল্পোদ্যোক্তারা। কারণ তারা যদি শুরুটাই ব্যয়বহুলভাবে করে তবে তাদের উৎপাদনে এর প্রভাব পড়বে। অনেকেই আবার ব্যাংকে গিয়ে নতুন বলে ঋণও পান না। বড় ও মাঝারিরা যেভাবে সুবিধা পায় বিশেষ করে সুদহারের ক্ষেত্রে, সেভাবে সুদহারে সুবিধা পান না নতুন উদ্যোক্তা। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ না দিলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির কোনভাবেই উন্নতি হবে না। তারা বিনিয়োগে আসবে না। আর তাদের সুযোগ দিতে হলে অবশ্যই তাদের জন্য সিঙ্গেল ডিজিটের সুদহার প্রয়োজন। এর জন্য ঋণের সুদ হারের পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের প্রাপ্তিটাও নিশ্চিত করতে হবে। আর শুরুতেই যদি কোন উদ্যোক্তা ১৪-১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নেন তাহলে তিনি ব্যবসা করবেন কিভাবে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ডাবল ডিজিটের সুদ ব্যবসায়ীদের গলার ফাঁস হয়েছে। চড়া সুদের কারণে খেলাপী ঋণ দিনের পর দিন বাড়ছে। উচ্চ সুদের কারণে পোশাক খাত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। তিনি বলেন, পোশাক খাতে বিশেষ কোন ছাড় নেই। তার ওপর ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ। তিনি আরও বলেন, পোশাক খাতে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ পেলে বছরে তৈরি পোশাক রফতানি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত। এদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার পরও বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না উদ্যোক্তারা। এর জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো গ্যাস, বিদ্যুত ও ঋণের উচ্চ সুদহার এবং ঋণ পেতে নানা সমস্যা। যে কারণে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে দেশী উদ্যোক্তারা ১৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর ঠিক আগের প্রান্তিক বা গত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) তারা ২৯ হাজার ১০৬ কোটি টাকা বিনিয়োগের নিবন্ধন করেছিলেন।
×