ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় : দ্বিতীয় খণ্ড পঞ্চম অধ্যায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের সাংবিধানিক একনায়কত্ব এবং আমার আমেরিকায় প্রথম ভ্রমণ (বুধবারের পর) তিনি পাকিস্তানে এক সময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন। খেলাধুলার বিষয়ে তার ছিল গভীর আকর্ষণ এবং তিনি সময় সময় পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত ছিলেন। আগেই বলেছি যে, ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে আমার প্রথম নিযুক্তি হয়। এই নিযুক্তির কিছুদিন পরেই আমাকে পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটিতে কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারীর পর থেকেই স্পোর্টস ফেডারেশনের নির্বাচিত কর্মকর্তারা বিদায় হন এবং সরকারই তখন স্পোর্টস ফেডারেশনের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য পদাধিকারীদের নিযুক্তি দিত। ঢাকার ক্লাবসমূহের প্রতিনিধিরা এই নির্বাহী কমিটির সদস্য হতেন। আমাকে সরকার কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে। আমি আমার ছাত্রজীবনে এবং শিক্ষক অবস্থায় স্পোর্টস ফেডারেশনের সঙ্গে নানাভাবে সংযুক্ত ছিলাম এবং বার্ষিক অলিম্পিকে ১৯৫৫ এবং ১৯৫৬ সালেই নানা খেলায় আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করি। সম্ভবত স্পোর্টসের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল বলে আমাকে ইপিএসএফের কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। সেই সময়ে ইপিএসএফের কার্যক্রম বাড়তে থাকে। ফুটবল ছাড়াও অন্যান্য খেলায় বিশেষ করে ক্রিকেটে যথেষ্ট নজর দেয়া হতো। আমি কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দেখলাম, ইপিএসএফের কোন যথাযথ গঠনতন্ত্র নেই। আরেকটি বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, ইপিএসএফের বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্পোর্টসের সঙ্গে সবিশেষ সম্পর্ক ছিল না। তারা শুধু অলিম্পিক খেলায় এবং কোন কোন প্রতিযোগিতায় যেমন- ফুটবল এবং ক্রিকেট এসবে অংশগ্রহণ করত। আমি সে জন্য ইপিএসএফের জন্য একটি গঠনতন্ত্র তৈরির কাজ হাতে নিই। সে সময় মোহাম্মদ মইনুদ্দিন নামে উপসচিব পর্যায়ের একজন সরকারী কর্মকর্তা ইপিএসএফের সচিব ছিলেন এবং তিনি তার দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করতেন। তিনি সম্ভবত ১৯৬২ সালেই একটি লম্বা বৈদেশিক প্রশিক্ষণে বিদেশ চলে যান। সে সময় তার শূন্য পদে আমাকে ইপিএসএফের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। আমাকে তখন প্রায় প্রতিদিনই ইপিএসএফে দফতর পরিচালনা করতে হতো। আমি এই সুযোগে ইপিএসএফের জন্য একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নে মনোনিবেশ করি। এক্ষেত্রে আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি জেলা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। আমি ১৯৬২ সালেই এ সম্বন্ধে একটি খসড়া প্রস্তুত করি। তাতে এমন একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় যেখানে একটি বৃহৎ কাউন্সিলে ঢাকা ক্লাবসমূহ এবং ঢাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (যথা- বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্্, সেনাবাহিনী ইত্যাদি) এবং প্রত্যেক জেলা থেকে ২ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসবেন। আমি ইপিএসএফের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই এই গঠনতন্ত্র সব জেলা প্রতিষ্ঠানের সমর্থন আদায় করে। ঢাকার ক্লাবগুলো এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিল না কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারাও এই গঠনতন্ত্র মেনে নেয়। তাদের অনীহার কারণ ছিল যে, ইতোপূর্বে তারাই ইপিএসএফ নিয়ন্ত্রণ করত এবং সব ক্লাবই এই নিয়ন্ত্রণে অংশ নিতো। এই বিষয়ে মোহামেডান স্পোর্টিং, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং ভিক্টোরিয়া ক্লাবই সবচেয়ে বেশি অখুশি ছিল। আমি এই কাউন্সিলে সদস্য হওয়ার জন্য মোটেই ইচ্ছুক ছিলাম না এবং আমার লক্ষ্য ছিল যে, নির্বাচিত ইপিএসএফের হাতে আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব। কিন্তু সিলেটের স্পোর্টস সংগঠন আমাকে তাদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিল। সিলেটের অন্য প্রতিনিধি ছিলেন লাল ব্রাদার্স পরিবারের বিমলেন্দু লাল দাস যিনি সাধু বাবু নামে পরিচিত ছিলেন। নবগঠিত কাউন্সিল ১৯৬৩ সালের শুরুতেই আমাকে ইপিএসএফের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্তি দেয়। স্বাভাবিকভাবে আমি ক্রিকেট বিভাগের সম্পাদকের দায়িত্ব পরিত্যাগ করি। এই কাজে আমাকে অনেক সময় দিতে হয় এবং প্রায় প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে ৮-৯টা পর্যন্ত আমাকে ইপিএসএফে বসতে হতো। ফাঁকে ফাঁকে অবশ্যি আমি বিভিন্ন খেলা দেখতে যেতাম। মাঝে মাঝে অংশও নিতাম। ভলিবল এবং বাস্কেট বল খেলায় আমি অংশ নিতাম, ফুটবল খেলা প্রায়ই দেখতে যেতাম এবং ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য খেলা হলে সারাদিন বা কয়েকদিন মাঠেই কাটাতাম। ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করার সময় পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত হার্ভার্ড ডেভেলপমেন্ট এডভাইজারি সার্ভিসের একজন পরামর্শক রিচার্ড কুপার আমার ব্যক্তিগত বন্ধুতে পরিণত হন। তারাই আমাকে হার্ভার্ডে এক বছরের জন্য কেনেডি স্কুলে অধিকতর পড়াশোনা করার উপদেশ দেন। কেনেডি স্কুলের তখনকার নাম ছিল গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আমেরিকার উন্নয়ন সহায়তার আওতায় তখন প্রতিবছর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং উইলিয়ামস কলেজে এক বছরের জন্য আমাদের মতো সরকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়। হার্ভার্ডে এই প্রশিক্ষণের জন্য যাদের মনোনয়ন দেয়া হতো তাদের মৌখিক পরীক্ষা করার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে পরীক্ষক আসতেন। আমাকে জনপ্রশাসন বিভাগ থেকে একদিন বলা হলো, এই ধরনের পরীক্ষকরা একটি নির্দিষ্ট দিনে ঢাকায় প্রশিক্ষণ প্রার্থীদের পরীক্ষা করবেন এবং আমাকে তাতে উপস্থিত থাকার জন্য হুকুম দেয়া হলো। আমি যে এই প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হয়েছি সেই খবরটি কিন্তু আগে জানতাম না। পরবর্তীকালে আমি জানলাম যে, হার্ভার্ডের উপদেষ্টাবৃন্দ জনপ্রশাসন বিভাগকে পরামর্শ দেন যে, তারা যেন আমাকে এ জন্য মনোনয়ন দেন। যাহোক, আরও কয়েক প্রার্থীর সঙ্গে আমারও একটি ইন্টারভিউ হলো। এই পরীক্ষকরা করাচী এবং লাহোরে অন্যান্য প্রার্থীর পরীক্ষা ইতোমধ্যেই নিয়ে নিয়েছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই খবর আসল যে আমি হার্ভার্ডে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছি। আমার আগে আরও কয়েকজন বাঙালী এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মতিউল ইসলাম ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম। তিনি ১৯৫৬/৫৭ সালে এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আমার আগের বছর আমার বন্ধু ড. এ. কে. এম. গোলাম রাব্বানীও এই মনোনয়নটি পেয়েছিলেন। তার আগের বছর আমার আর এক বন্ধু কাজী ফজলুর রহমান এই মনোনয়ন পান। আমার অজান্তে আমার বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে সামান্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। লাট সাহেব আবদুল মোমেন খান আমার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাকে নাকি টিকটিকিরা জানিয়েছেন আমি সামরিক শাসন পছন্দ করি না এবং তার প্রতিও আমার আনুগত্য ছিল না। সামরিক শাসন আমি পছন্দ করতাম না ঠিকই কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমি কাজে কখনো গাফলতি করতাম না বরং প্রতিটি কাজেই আমার ছিল পরিপূর্ণ নিবেদন। লাট সাহেব আমার প্রশিক্ষণে বিদেশ যাওয়া অনুমোদনে গড়িমসি করছিলেন। তখন তার একান্ত সচিব আখলাক হোসেন, যিনি আমার বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আমাকে সবিশেষ সাহায্য করেন। তিনি লাট সাহেবকে বললেন, সে তো বিদেশ চলে যাবে এবং ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তানে পদায়ন নাও পেতে পারে। সুতরাং তার চলে যাওয়াটা আপনার জন্য তো ভালই হবে (এই কাহিনীটি আখলাক আমার বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে আমাকে অবহিত করেন)। তাই একটি প্রশিক্ষণ উপলক্ষে আমার বিদেশ যাত্রা নিশ্চিত হলো। কাকতালীয়ভাবে আমি প্রশিক্ষণ শেষে আর কখনো মোনেম খানের অধীনে কাজ করার সুযোগ পাই নি। কেন্দ্রীয় সরকারে পদায়িত হওয়ায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে আর কোনদিনই চাকরি করিনি; দেশ স্বাধীন হবার পর বহুদিন পরে বাংলাদেশে সরকারী চাকরিতে নিযুক্তি পাই। অবশ্য পাকিস্তানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কার্যকালে আমি মোনেম খান সাহেবের বেশ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠি। আমি ঢাকায় এলে বা তিনি পিন্ডি গেলে প্রায়ই আমাকে ডেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কথা বিস্তৃত পরিধিতে আলোচনা করতেন এবং আমাকে তার একজন সমর্থক বলে বিবেচনা করতেন। তিনি পিন্ডিতে অবস্থান কালে ১৯৬৯ সালে পদত্যাগ করেন এবং তখনও তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে সলাপরামর্শ করেন। অবশ্যি পদত্যাগের বিষয় ছিল তার ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যেকার গোপনীয় বিষয়। ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাস থেকে আমি হার্ভাড যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। হাওয়াই জাহাজ ভ্রমণের এজেন্টদের কাছ থেকে আমি জানলাম যে, আমি বোস্টনে যাওয়ার জন্য যে টিকিট পাব তার সঙ্গে আরও ৫০০ টাকা যদি যুক্ত করি তাহলে আমি রাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ভ্রমণের টিকেট পেতে পারি। আমি সেটাই করতে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার পরিবার তখন হলো ৩ জনের, আমার ৭/৮ মাস বয়সের মেয়ে এবং আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমি আমার ভ্রমণ পরিকল্পনাটি নিম্নোক্তভাবে নির্ধারণ করলাম, ঢাকা থেকে কলকাতা এবং সেখানে একদিন অবস্থান করে ব্যাংকক। সেখানে আর একদিন থেকে হংকং। হংকং-এ দু’দিন থেকে টোকিও এবং সেখানেও দু’দিন বিরতি। টোকিও থেকে হনুলুলু এবং সেখানেও দু’দিন বিরতি। হনুলুলু থেকে সানফ্রান্সিসকো। সেখানে একদিন বিরতি এবং সানফ্রান্সিসকো থেকে ডালাস। ডালাসের অনতিদূরে কলেজ স্টেশনে আমার ভাই ড. মুহসি তখন টেক্সাস এগ্রিকালচারাল এন্ড মেকানিক্যাল কলেজে পিএইচডির জন্য কাজ করছিলেন (পরবর্তীকালে টেক্সাস এ এন্ড এম কলেজ টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়)। আমার ভাই ১৯৬১ সালে আমার বিয়ের কয়েক মাস আগে কলেজ স্টেশনে গমন করেন। ডালাস থেকে আমার সরাসরি বোস্টনে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আমরা ব্যাংকক থেকে হংকং-এ পৌঁছতে অনেক দেরি করে ফেললাম। কারণ সেদিন এই রাস্তায় একটি বড় হারিকেন (সমুদ্র ঝড়) হয়। আমরা অনেক কষ্ট করে সন্ধ্যার সামান্য আগে তাইওয়ানে পৌঁছলাম। চলবে...
×