ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : পল ম্যাসন;###;অনুবাদ : এনামুল হক

সোভিয়েতের মতোই ধসে পড়তে পারে পশ্চিমা ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সোভিয়েতের মতোই ধসে পড়তে পারে পশ্চিমা ব্যবস্থা

কাজানের একটি মধ্যযুগীয় নগরদুর্গ। এর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশাল দুই নদীর জলরাশি এখন বরফে জমাটবেঁধে গোটা দৃশ্যপট শ্বেতশুভ্ররূপ ধারণ করেছে। এক শনিবারের বিকেলে দেখা গেল বলিষ্ঠ গড়নের গুটিকয়েক স্থানীয় লোক সেখানকার বরফের স্তূপের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘুরছে। কখনও মসজিদ, কখনও ক্রিস্টমাসের আলো এবং কখনওবা সোভিয়েত যুগে নির্মিত মূর্তিগুলোকে পিছনে রেখে সেলফি তুলছে। শেষবারের মতো আমি যখন রাশিয়ায় ছিলাম তা পঁচিশ বছর হয়ে গেছে। সেসময় বরিস ইয়েলৎসিনের অর্থনৈতিক সংস্কারের বিশৃঙ্খলাময় প্রথম দিকের দিনগুলোতে আমি বামপন্থীদের পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। জীবদ্দশার অর্ধেক সময় পর আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি ঘরভর্তি কিছু মানুষের উদ্দেশে ভাষণ দিতে যারা পুঁজিবাদের পরিবর্তে উন্নততর কোন ব্যবস্থা কায়েমের বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। সহসা আমরা অভিন্ন কিছু একটা পেয়ে গেলাম। এখন আমরা জানি এমন একটা ব্যবস্থা দেখতে কেমন লাগে যা একসময় মনে হচ্ছিল স্থায়ীভাবে ধসে পড়ছে। আমি এখানে আসার পর থেকে যারাই আমার সঙ্গে দেখা করতে ও কথা শুনতে এসেছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই সমকালীন শিল্পকলা বা দর্শনচর্চার সঙ্গে যুক্ত। আমি পুতিনের সিরিয়া ও ইউক্রেন নীতির সমালোচক। আমার সাক্ষাতকার নিতে আসা সাংবাদিকরা মূলত সাংস্কৃতিক ম্যাগাজিনগুলোর জন্য লেখালেখি করে থাকেন। এগুলো ঠিক নতুন রক এন রোল না হলেও সবচেয়ে নিরাপদ বুদ্ধিবৃত্তিগত স্থান যেখানে সমালোচনাধর্মী চিন্তাধারার জন্ম হয়ে থাকে। পুতিন ২০১১ সালের নির্বাচনকে হরণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এ থেকে উদ্ভূত বিক্ষোভ আন্দোলনকে দমন করা হয়। সেই আন্দোলনে অংশ নেয়া তরুণরা তারপর থেকে ক্রুদ্ধ নীরবতার রাজ্য ফিরে গিয়েছিল। রুশ বুদ্ধিজীবীদের জন্য এটা ঠিক নতুন কোন পরিস্থিতি ছিল না। ছাত্র বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৮৮৭ সালে লেনিনকে এখানে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী ৩০ বছরের অধিকাংশ সময় তার কেটেছিল নির্বাসিত জীবনে অথবা আত্মগোপনে। এরপর বলশেভিকরা এসে আরও সত্তর বছর বাক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন করে রাখে। এখন রাশিয়ার পুঁজিপতি অলিগার্করাও তা দমনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। এমন পরিস্থিতির মুখে রুশ শিল্পী, দার্শনিক ও সাংবাদিকরা কেন তাদের এই বিশ্বাসে অটল রয়েছেন যে, পরিবর্তন একটা ঘটবে? সংক্ষেপে বলতে গেলে তার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা এমন একটা কিছুর নৈতিক ও ভৌত পতন ঘটতে দেখেছেন যা একদা চিরস্থায়ী বলে মনে হয়েছিল। আর সেটা হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব¡বিদ আলেক্সি ইউরচাক একটা বইয়ে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বইয়ের নামের মধ্যেই অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বইয়ের নাম ‘এভরিথিং ওয়াজ ফর এভার আনটিল ইট ওয়াজ নো মোর’। ইউরচাক এই বাস্তবতার দ্বারা আবিষ্ট হয়েছিলেন যে, সোভিয়েতের পতনের ভবিষ্যদ্বাণী কেউ করেনি। কিন্তু যখন এর পতন ঘটল তখন অনেকেরই উপলব্ধি হয় যে, তারা তাদের অন্তরে বরাবরই এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল। গর্বাচেভের নেতৃত্বে পেরেস্ত্রইকার যুগে যখন এই উপলব্ধির উন্মেষ ঘটে যে, সোভিয়েতের পতন অত্যাসন্ন তখন অনেক মানুষেরই চেতনার জগতে আকস্মিক এক ছেদ ঘটে যায়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ তাদের আচরণ-কথাবার্তায় এমনকি চিন্তাচেতনায় ধরে নিয়েছিল যে, সোভিয়েত ব্যবস্থাটা চিরস্থায়ী। সোভিয়েত শাসনের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে তাদের নিন্দাবাদ সত্ত্বেও তারা কুচকাওয়াজে গিয়েছিল। সভা সমাবেশে অংশ নিয়েছিল এবং রাষ্ট্রের চাহিদামতো আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছিল। ২০১৬ সালের নবেম্বরে ট্রাম্পের বিজয়ের পর থেকে একথা বিশ্বাস করা সম্ভব হয়ে উঠেছে যে, পাশ্চাত্যেও সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুরূপ বিশ্বায়ন ও উদার মূল্যবোধের পতন ঘটবে। এই সমান্তরাল ঘটনা দুটো অনস্বীকার্য। আমরাও ত্রিশ বছর ধরে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাধীনে বাস করেছি সেটি তার নিজের চিরস্থায়িত্ব ঘোষণা করেছিল। বিশ্বায়ন ছিল এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি এর এক বাস্তব অবস্থামাত্র। যে দেশটা বিশ্বায়নের পরিকল্পনা করেছে, একে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে এবং এ থেকে সর্বাধিক মাত্রায় লাভবান হয়েছে সেই দেশটাই যখন বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ভোট দেয় তখন এমন সম্ভাবনাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, এই ব্যবস্থার (বিশ্বায়ন) অবসান ঘটতে চলেছে এবং সেটা সহসাই। তাই যদি হয় তাহলে আপনি উদারপন্থী, মানবতাবাদী, গণতন্ত্রী হলে এমন সম্ভাবনার কথা আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে যা হতে পারে আরও বেশি আঘাতদায়ক। আর সেটা হলো এই যে, গোষ্ঠীতান্ত্রিক (অলিগার্কিক) জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ব্যর্থ অর্থনীতির বিকৃত রূপ। ১৯৯০এর দশকের প্রথম দিকে ইয়েলৎসিনের আমলে যখন নিদারুণ দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক ধসের সূত্রপাত হলো আমি তখন রুশ সমাজকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার গর্ভে নেমে যেতে দেখেছি। আমরা স্ট্যালিনবাদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিত্যক্ত স্থাপনাগুলোতে বাতিল ঘোষিত সোভিয়েত পাঠ্যবই, লেনিনের আবক্ষ মূর্তি এবং বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যবিবরণী সমূহের মধ্যে সভা করেছি। তখন রাজপথে সহিংসতা চলছিল এবং রাশিয়ার সম্পদ যারা কুক্ষিগত করে রেখেছিল তাদের বেডরুমগুলোতে চলছিল জোচ্চুরি। সেখানে যে ক্লেপটোক্রাট সর্বাধিক ক্ষমতা খাটাতে পেরেছিল সম্পদের মালিকানা তারই হাতে এসে পড়েছিল। ১৯৯০-এর দশকের সেই অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে তুলনা করলে পুতিনবাদকে সঙ্কট থেকে পুনরুদ্ধারের উপায় বলে মনে হয়। পুতিন কূটনৈতিকভাবে একঘরে হওয়া এবং গণতান্ত্রিক অধিকার দমনের বিনিময়ে প্রবৃদ্ধি, শৃঙ্খলা ও জাতীয় গৌরব পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন বিশ্বের সর্বত্রই ক্ষুদে পুতিনের আবির্ভাব ঘটেছে। যেমনÑ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওবরান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান, ফ্রান্সের ভাবি ফ্যাসিস্ট প্রেসিডেন্ট ম্যারিন লি পেন। তারা যেমনটি চাইছেন সেভাবে পাশ্চাত্য যদি অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদে অধপতিত হয় তাহলে ৫০ বছরের কম বয়সী প্রত্যেকে সেই একই ধরনের আদর্শিক আঘাত পাবে যেমনটি রুশরা পেয়েছিল ১৯৮০’র দশকের শেষভাগজুড়ে। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রায় তিন দশকে ধরে সাধারণ ধারণা বিরাজ করছে যে, বর্তমান কাঠামোটাই চিরস্থায়ী। বিশ্বায়ন যদি শ্রেফ একটা সাময়িক ও পরিবর্তনযোগ্য ব্যাপার হয়ে থাকে তাহলে সোভিয়েত শিক্ষায়তনে যেমনটি হয়েছিল ঠিন তেমনি একদা পরম সমাদৃত পাঠ্যপুস্তকগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে। এক্ষেত্রে এক মস্ত পার্থক্য আছে। বিগত সোভিয়েত যুগের বিরুদ্ধবাদীরা ‘পাশ্চাত্যের’ সাধারণ ধারণার অধীনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য লড়েছিল। আমাদের ক্ষেত্রে বিদেশভীতি দ্বারা চালিত আমজনতাবাদ যদি জয়যুক্ত হয় তাহলে আকাক্সিক্ষত হবার মতো কোন ‘পাশ্চাত্য’ থাকবে না। উদারপন্থী গণতান্ত্রিক সমাজগুলো যদি ওবরানের হাঙ্গেরির পথে যেতে শুরু করে তাহলে আমাদের সাহায্য করার মতো কোন বৈদেশিক শক্তি থাকবে না। আমাদের শেষ মহৎ আশা হব নিজেরাই। গোষ্ঠীতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের দিকে এই দ্বিতীয়দফা বিরাট ধস থামানোর জন্য আমরা বিপুল সংখ্যায় আছি। আমরা নেটওয়ার্কভুক্ত, সচেতন, শিক্ষিত এবং এখনকার জন্য মনগতভাবে সহনশীল। আমরা একত্রে যুক্ত হয়ে প্রতিরোধ যোগালে যারা রাশিয়ায় নীরবে নিভৃতে এ কাজটা করে চলেছে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারব। পুতিনের সমালোচক তরুণ প্রজন্ম হয়ত সিনিক ভাবধারা, ক্রান্তি ও অন্যমনস্কতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। কিন্তু পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের রয়েছে হীরার মতো কঠিন বিশ্বাস। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান
×