ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ডলারের দাম বাড়ছে, সোনার দাম কমছে ॥ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

ডলারের দাম বাড়ছে, সোনার দাম কমছে ॥ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি

ডলারের দাম, সোনার দাম, ভারতীয় মুদ্রার সরবরাহ এবং রেমিটেন্স এখন বড় আলোচ্য বিষয় বাজারে। প্রায় মাসখানেক আগে ভারত সরকার তার ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করেছে। এটাও বাজারে বেশ আলোচনার বিষয়। বলা হচ্ছে, ডলারের দাম, সোনার দামের সঙ্গে সম্পর্কিত ভারতীয় মুদ্রার মান ও সরবরাহ। কীভাবে? দৃশ্যত নোট বাতিলের বিষয়টি ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। ভারত সরকার বলছে, কালো টাকার সর্বগ্রাসী প্রভাব বন্ধের উদ্দেশ্যেই বড় নোট বাতিল করা হয়েছে। এই কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে নকল রুপি, যা ভারতের অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই দুই যুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৯৭৮ সালের মোরারজি দেশাইয়ের সরকারের পর এই প্রথম বড় নোট বাতিল ঘোষণা করলেন। দৃশ্যত এতে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। কিন্তু বাস্তবে আছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ গভীর। দৈনন্দিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাঁচামাল এবং শিল্পের যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে হাজার রকমের জিনিসপত্র ভারত থেকে আমদানি হয়। বাংলাদেশ থেকে পোশাক বস্ত্রাদিসহ বেশ কিছু ধরনের পণ্য ভারতে রফতানি হয়। এর মধ্যে পাটও আছে। বস্তুত, ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় আমদানির বাজার। চীনের পর আমদানি বাণিজ্যে ভারত দ্বিতীয়। পূর্ব-ভারতে বাংলাদেশের প্রচুর পণ্য রফতানি হয়। এছাড়া হাজার হাজার বাংলাদেশী ভারতে যায় প্রতিবছর। উচ্চবিত্তরা চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুর যায়। মধ্যবিত্ত, এমনকি সাধারণ লোকজনও চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। বছরে কত সংখ্যক লোক ভারতে যায় তার হিসাব দুই রকমের- এক. সরকারীভাবে, আরেক বেসরকারীভাবে। সরকারীভাবেই ৮-১০ লাখ লোক প্রতিবছর ভারতে যায়। এই সূত্রে অনেক বাংলাদেশী এবার ভারতীয় মুদ্রা অচল ঘোষণার কারণে দারুণ মার খেয়েছে। যারা নিয়মিত ভারতে যান নানা কারণে তাদের পকেটে দুই-চার-ছয় হাজার ভারতীয় রুপি থাকেই। ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট অচলের পর এই শ্রেণীর লোক তা ‘কার্ব’ মার্কেটে ৫০-৬০ শতাংশ লোকসানে বিক্রি করেন। যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন তাদের অনেককেই বিনা চিকিৎসায় ফেরত আসতে হয়েছে। অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ীরা, যারা ‘হুন্ডি’র ওপর নির্ভরশীল। হাজার হাজার কোটি টাকার এই ‘অবৈধ’ ব্যবসায় সোনা, টাকা, রুপি ও ডলার ইত্যাদি ব্যবহার হয়। এই ব্যবসা অর্থাৎ গরু আমদানির ব্যবসা যেহেতু ঋণপত্র (এলসি) খোলার মাধ্যমে হয় না, সেহেতু এখানে সোনা, টাকা, রুপি ও ডলার ব্যবহার হয় লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য। অনুমান করা যায়, গরু ব্যবসায়ী ও হুন্ডিওয়ালাদের কাছে ছিল বেশ কিছু ভারতীয় মুদ্রা। তারা যত চেষ্টাই করুন না কেন ভারত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেখে মনে হয়, তারা তাদের ভারতীয় মুদ্রার ‘ক্যাশ হোল্ডিং’ সর্বাংশে নতুন মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করতে পারবেন না। এখানে লোকসান তাদের গুনতেই হবে। এছাড়া রয়েছে সোনার বিষয়টি। ভারত সরকার সোনার হোল্ডিং-এর ক্ষেত্রেও সিলিং ঘোষণা করেছে, যদিও এই বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে ভারতীয় বিবাহিত নারীরা ৫০০ গ্রাম, অবিবাহিত নারীরা ২৫০ গ্রাম এবং পুরুষরা ১০০ গ্রাম সোনা রাখতে পারবেন। এই নতুন নিয়মের ফলে ভারতে সোনার চাহিদা কমে গেছে। এখন শীতকাল। এই সময়েই বিয়ে-শাদি ভারতে বেশি হয়। এখন সোনার চাহিদা বাড়ে। কিন্তু ‘সাদা’ টাকার অভাবে অনেক বাবা-মা এবার বিয়ে-শাদিতে সোনা উপহার দিতে পারবেন না। এমনকি যারা উপঢৌকন হিসেবে সোনার অলঙ্কার দেন তারাও পারবেন না। ফলে দেখা যাচ্ছে ভারতে সোনার চাহিদা কমেছে। এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশেও পড়েছে। জানা কথা, বাংলাদেশের কিছু সোনা ভারতে চোরাচালান হয়। ভারতের চাহিদা কমায় বাংলাদেশের সোনার বাজারেও তার প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে। সোনার বাজার বেশ পড়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন, তার ওপর ভারতীয় বাজারের মন্দা- এই দুই কারণে ঢাকার সোনার বাজার এখন মন্দা। ভরিতে সোনার দাম দুই-তিন-চার হাজার টাকা কমেছে বলে বলা হচ্ছে। সোনার বাজার পড়লে কি হবে, ডলারের বাজার চাঙ্গা হয়েছে। বহুদিন ‘কার্ব’ মার্কেটে ডলারের দাম ছিল আশি, একাশি ও বিরাশি টাকা। অনেক সময় ব্যাংকের দামের চেয়েও কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ছিল কম। কিন্তু এখন বেশি। ডলারের মূল্য কার্ব মার্কেটে ৮৪ টাকারও বেশি অনেক ক্ষেত্রে। এর কারণ অবশ্য অনেক। সর্বশেষ কারণ ভারতীয় মুদ্রার অচলীকরণ। এখন যারা ভারতে যায় তাদের একমাত্র ভরসা ডলার। আগে অনেকে কার্ব মার্কেট থেকে ভারতীয় মুদ্রা ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট কিনে নিয়ে যেত, এখন তা করে না বলে বাজারের খবর। কারণ ভারতে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট অচল হয়েছে, এর বদলে দেয়া হচ্ছে ২০০০ রুপির নোট। বাজারে ৫০০ রুপির নোট নেই, ১০০০ রুপির নোট নেই। ১০০ রুপির নোটের ওপর প্রচ- চাপ। কারণ তার সরবরাহ বেশি নেই। অথচ ২০০০ রুপির নোট দিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটানো যায় না। এমতাবস্থায় এখন যারা ভারতে যায় তারা ডলার নিয়ে যায়। এর চাপ ডলারের মূল্যে পড়েছে। অবশ্য ডলার উর্ধমুখী হওয়ার আরও কারণ আছে। রেমিটেন্সের পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আবার আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই; কিন্তু এই বৃদ্ধির হার কম, আমদানি বৃদ্ধির হার বেশি। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কেবল সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেই রেমিটেন্স প্রবাহ বিগত পাঁচ মাসে হ্রাস পেয়েছে যথাক্রমে ২৩ ও ২১ শতাংশের মতো। এদিকে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। অথচ রফতানি বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ আমদানি বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। বলা হচ্ছে তা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির কারণে। অতএব কি দাঁড়ল? দাঁড়াল ডলারের চাহিদা বেশি। এর সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছে ভারতযাত্রী বাংলাদেশীদের চাহিদা। সব মিলে ডলারের উল্লস্ফন। আরও কারণ আছে। ডলার এখন বেশ বেশি হারে আসছে বেসরকারী চ্যানেলে। ‘বিকাশের’ ব্যবস্থাটাকে হুন্ডিওয়ালারা খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে বলে ধারণা। সরকার এই ক্ষেত্রে মানুষকে সাবধান করে দিচ্ছে। কিন্তু অধিকতর ‘বিনিময় হার’ পাওয়ার আশায় ‘ওয়েজ আর্নাররা’ বেসরকারী চ্যানেলে ডলার পাঠাচ্ছে। এসব কারণে ডলারের মূল্য অনেকদিন স্থিতিশীল থেকে এবার কিছুটা বেড়েছে। আগেই বলেছি, অন্যদিকে হ্রাস পেয়েছে সোনার দাম। এদিকে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে কিছুটা স্থবিরতা। ‘কারেন্সি’র অপ্রতুলতার কারণে আমদানি-রফতানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি প্রদান কঠিন হয়ে পড়েছে বলে আমদানিকারকগণ অভিযোগ করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মালের অর্ডার দিচ্ছেন না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ডলার, সোনা, টাকা এবং রুপির মূল্য ও সরবরাহ একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। এমনকি রুপির সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ নেপালী রুপির, ভুটানী কারেন্সির। ভারতীয় রুপি, নেপালী রুপি, ভুটানী মুদ্রা অবাধে বিনিময়যোগ্য। এই অর্থে ভারতীয় বড় রুপির অচলীকরণ নেপাল ও ভুটানেও সমস্যা তৈরি করেছে বলে খবরের কাগজে খবর বেরিয়েছে। পরিশেষে বলা দরকার, রেমিটেন্স হ্রাস, আমদানি বৃদ্ধি এবং রফতানির আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না ঘটায় সরকারী মহলে একটা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসেছে। তবে সহসাই কোন সমস্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়বে না। যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে প্রায় ৮ মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে জানা গেছে। নবেম্বর মাসান্তে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ সহসাই কমতির দিকে যাবে বলে মনে হয় না। পোশাক রফতানি খাত রফতানিতে ভাল করছে। রেমিটেন্সের বৈরি পরিবেশের মধ্যেও পোশাক রফতানি ভালই হচ্ছে। এর প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ভাল। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আন্তঃদেশীয় অবাধ বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করতে শুরু করেন তাহলে এটা আমাদের পক্ষেই যাবে। পোশাক রফতানিতে চীন ও ভিয়েতনাম আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পদক্ষেপ তাদের পোশাক রফতানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঐ বাজার বাংলাদেশ সহজেই দখল করতে পারে। এর জন্য প্রস্তুতি নেয়া দরকার। পোশাক খাতের কারখানাগুলো দেখা যাচ্ছে আধুনিকীকরণ শুরু করেছে। কাগজে দেখলাম এর জন্যই মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেশি হচ্ছে। যদি এই আধুনিকীকরণের কাজ চালু থাকে এবং ‘কমপ্লায়েন্স’ ইস্যুতে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় তাহলে পোশাক খাতের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। রফতানিতে নতুন খাত হিসেবে চামড়াজাত দ্রব্য, ওষুধ ইত্যাদি সামনে আসছে। আশা করা যায়, রেমিটেন্সের প্রবাহ হ্রাসে যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে তা রফতানি খাত পুষিয়ে নিতে পারবে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×