ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দালালমুক্ত স্থাপনা

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

দালালমুক্ত স্থাপনা

সাড়ে সাত কোটি বাঙালী একটি ডাকে জেগেছিল রণাঙ্গনে। অস্ত্র হাতে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পরাজিত করেছিল দখলদার হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসরদের। টানা নয় মাস সারা বাংলাকে জেলখানা বানিয়ে তারা নির্মম, নৃশংস ও বর্বরভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল। একই সঙ্গে মা-বোনদের সম্ভ্রমহানিও করেছিল। পুড়িয়ে দিয়েছিল ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ধ্বংস করেছিল সেতু, কালভার্ট, শহীদ মিনার পর্যন্ত। ওদের হাত থেকে নিস্তার পায়নি বাংলাদেশের শহর, গ্রাম। প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলেও এরা হানা দিয়ে বাঙালী নিধনে মত্ত ছিল। দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল এক কোটি বাঙালীকে। পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগী হিসেবে এক শ্রেণীর বাঙালী রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির বেইমান, নাফরমানরা ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনকে নস্যাত করতে চেয়েছিল। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী এবং বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। পাশবিকতার নিদর্শন রেখে গেছে হানাদারদের সহযোগীরাও। এই সব মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানী দালালদের বিচারকাজ শুরু হয় স্বাধীনতার পর পরই। দালাল আইনে বিচারকাজ চালু এবং সাজাদানও চলে। তবে অধিকাংশ অপরাধীই পালিয়ে গিয়েছিল একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের পর পরই। পঁচাত্তর সালের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক জান্তারা ক্ষমতা দখল করে দেশকে আবার পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। জান্তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তি আলবদর, রাজাকার, ঘাতক-দালাল, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল, ধর্ম ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন শুধু নয়, রাজনীতি করার সুযোগও প্রদান করে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিগৃহীত করার কাজটিও শুরু হয় সেই সঙ্গে। যাদের হাতে বাঙালীর রক্তের দাগ, তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন এবং ক্ষমতার অংশীদারও করা হয়। এরা ক্রমশ মুখোশ ও খোলস উন্মোচন করে স্বরূপে আবির্ভূত হয়। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনাগুলো যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও দালালদের নামাঙ্কিত হতে থাকে। রাস্তাঘাট, সেতু, ছাত্রাবাসের নামকরণও করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের নামে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোও স্বাধীনতাবিরোধীদের নামাঙ্কিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে বিচারে সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারের নামে বিখ্যাত সড়ক যশোর রোডের নামকরণ করা হয়। যশোর রোড নিয়ে মার্কিন কবি গিনসবার্গ তার বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।’ এই সড়ক হয়েই একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার যশোরে প্রবেশ করেছিল। বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ থেকে কলকাতার দমদম পর্যন্ত এই সড়কটি। ১৯৭৮ সালে সামরিক জান্তা শাসক জিয়াউর রহমান সড়কটি যুদ্ধাপরাধী খান এ সবুরের নামে নামকরণ করে। দালাল আইনে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শিরোমনি শাহ আজিজুর রহমানের নামে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়। এভাবে বহু যুদ্ধাপরাধীর নাম বিভিন্ন স্থাপনায় সংযুক্ত করা হয়। তাই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন দু’জন অধ্যাপক ও সাংবাদিক মুনতাসীর মামুন এবং শাহরিয়ার কবির। আবেদনের শুনানি শেষে আদালত যশোর রোড নাম পুনর্স্থাপন এবং ছাত্রাবাসের নাম থেকে যুদ্ধাপরাধীর নাম বাদ দেয়ার নির্দেশ দেয়। আদালতের আদেশ যথাযথভাবে পালন হয়েছে বলা যাবে না। আন্দোলনকারীরা আরও ২০ জন স্বাধীনতাবিরোধীর নামে স্থাপনার তালিকা আদালতে পেশ করেন। আদালত আদেশ প্রদান করে যে, দেশের সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলতে হবে। ‘সব সম্ভবের দেশ’ হিসেবে খ্যাত বলেই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা গাড়িতে পতাকা ওড়ায়, মন্ত্রিসভায় আসন পায়, নিজেদের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও এই অবস্থা মেনে নেয়া কষ্টকর। মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সংশ্লিষ্টদের উচিত স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে গড়া স্থাপনার তালিকা প্রণয়ন এবং তা মুছে ফেলার কাজে এগিয়ে আসা।
×