ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ চন্দ্র মাহাতো

ভিন্ন ভাষায় কণ্ঠযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

ভিন্ন ভাষায় কণ্ঠযুদ্ধ

কোন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি সর্বোচ্চ রাজনৈতিক বিষয়। সুতরাং তা রাজনৈতিক নেতৃত্বে হয়ে থাকে। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা স্বাধীনতার সংগ্রামে জয়যুক্ত হওয়া অসম্ভব, যদি না সর্বস্তরের জনগণের পূর্ণ সমর্থন থাকে এবং যদি বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা না থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও রাজনৈতিক নেতৃত্বেই অজির্ত হয়েছে। সহযোগিতা দিয়েছে সব শ্রেণীর মানুষ। এমনকি মার্কিন সরকার বাংলাদেশের মানুষের পাশে না থাকলেও মার্কিন জনগণের অনেকেই পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পী সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান (এ বছর নোবেল বিজয়ী) জিম কেল্টনার, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, বিলি প্রেস্টন, এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেল, রিংগো স্টার, ক্লাউস ভরম্যান ও রবিশংকরের নাম অন্যতম। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ জোয়ান বায়েজের গান ও এ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা সারা পৃথিবীর মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। বিশেষ করে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমেই মূলত বিশ্বপরিসরে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট পৌঁছে যায়। এ কনসার্টের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ প-িত রবিশংকর। তার জন্ম ভারতের পশ্চিম বাংলায়। তিনি তখন বসবাস করতেন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে। ভারতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে আসার খবর শুনে তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠেন। উদ্বাস্তুদের মধ্যে তাঁর অনেক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজনও ছিল। তিনি তাদের, বিশেষ করে শিশুদের সাহায্য করতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। রবিশঙ্কর বাংলায় ‘জয় বাংলা’সহ বেশকিছু গান বাঁধেন। এমনকি তিনি এ্যাপেল রেকর্ড থেকে একটি গানের এ্যালবামও বের করেন। ১৯৭১ সালের মে মাসে তিনি অনুধাবন করেন, বড় একটা কিছু করা দরকার। বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে তিনি একটি চ্যারিটি কনসার্টের পরিকল্পনার কথা জানান। হ্যারিসন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহে হ্যারিসন কাটিয়ে দেন সঙ্গীতজ্ঞদের তালিকা বানাতে। তিনি সবার সহানুভূতিও পেয়ে যান। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট কনসার্টের দিন নির্ধারিত হয়। হ্যারিসন ডিলানের গান সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। মুহূর্তেই বাংলার মানুষের ওপর পাক বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পৃথিবীর বড় বড় গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কনসার্টের বার্তা নিয়ে কোন সংশয় ছিল না। বাংলাদেশ শব্দটি ব্যবহার করে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেন। এটা লক্ষণীয় তারা পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার মতো শব্দ ব্যবহার করেননি। সরাসরি বাংলাদেশ শব্দটি ব্যবহার করেন। শুরুর আগে রবিশঙ্কর বলেন, ‘এই কনসার্ট শুধু একটি অনুষ্ঠান নয় এর এক বার্তা রয়েছে। আমরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছি না। আমরা শিল্পী। তবে বাংলাদেশে আজ যে তীব্র যন্ত্রণা, বেদনা ও দুঃখের ঘটনা ঘটছে, আমাদের সঙ্গীত দিয়ে আমরা তা আপনাদের উপলব্ধি করাতে চাই। আমরা তাদের কথা উপলব্ধি করাতে চাই, যারা বাংলাদেশ থেকে শরনার্থী হয়ে ভারতে এসেছে।’ হ্যারিসন শেষ করেন ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ দিয়ে। কনসার্টের সফলতা ছিল রবিশঙ্কর ও হ্যারিসনের কল্পনারও বাইরে। পৃথিবীর বহু মানুষ এই কনসার্টের মাধ্যমেই বাংলাদেশের নাম শুনেছিল। এই কনসার্ট থেকে আয় হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ইউনিসেফের মাধ্যমে এ অর্থ ত্রাণের কাজে ব্যয় করা হয়। এই কনসার্টের বাণীর ভেন্যুকে ছাড়িয়েও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে দিকে দিকে। আরেকজন বিদেশী শিল্পীর কথা না বললেই নয় তিনি হলেনÑ জোয়ান বায়েজ। আজীবন তিনি যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান হ্যারিসন বব ডিলান কিংবা রবিশঙ্করের মতোই। তিনিও গিটার হাতে বাংলাদেশের মানুষদের ওপর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রচনা করেছিলেন এক অমর সঙ্গীতেরÑ ‘সং অফ বাংলাদেশ’। যে সঙ্গীতের চরণে চরণে মূর্ত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অব্যক্ত বেদনা। ছাত্রদের ওপর গণহত্যা, সেনাবাহিনীর তা-ব, মানুষের হাহাকার, কুমারী মায়ের অসহায় দৃষ্টি, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, প্রতিরোধ সবকিছুই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে গানটিতে। জোয়ান বায়েজের কথা আর সুরের এক স্বপ্নীল জাদুস্পর্শে। পুরো গানটিতে তিনি মোট ২২ বার ‘বাংলাদেশ’ এর নাম উচ্চারণ করেন। তিনি একজন মার্কিন ফোঁক গায়িকা ও সমাজকর্মী। তাঁর ‘সং অফ বাংলাদেশ’ গানের শুরুটা ছিল এ রকম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ/বাংলাদেশ অস্তাচলে যেখানে দিন শেষ/ লাখো প্রাণের রক্তে রাঙ্গা দেশ/কি চমৎকার শব্দমালা! তাঁর হৃদয়ে মানবিকতার বিষয়টি কত প্রখর ছিল এই গানের মধ্য দিয়েই আমরা অনুধাবন করতে পারি। সেই সময় যারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সঙ্গীতের সুর নিয়ে তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। জর্জ হ্যারিসন ২০০১ সালের ৩০ নবেম্বর মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন বব ডিলান। বিদেশী এসব শিল্পীর প্রত্যেকের অবদানই আমাদের জন্য ছিল অমূল্য। তারাও আমাদের একাত্তরেরই একটি অংশ। আমাদের বিজয় উল্লাসের সঙ্গী তারাও।
×