ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ কামরুল হাসান

সুলতানে কুপোকাত

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

সুলতানে কুপোকাত

শৈশবে ইংরেজী সিরিয়াল ম্যাকগাইভারের স্মৃতি মাঝ বয়সী সকলেই মনে রাখার কথা। প্রতি বুধবার রাত ৯টায় শুরু হওয়া এই সিরিজের দর্শক টিভিপর্দায় এতই নিবিষ্ট থাকত যে, এর আবহ সঙ্গীতও বহুদিন মানুষকে স্মৃতিবিজরিত করে তুলত। ছাত্র-অভিভাবক সকলেই পড়াশোনা ও কাজ বন্ধ রেখেই একাগ্রচিত্তে বসে থাকত টিভিপর্দায়। ম্যাকগাইভারসহ বেশ কিছু বিদেশী সিরিয়াল তখন প্রচারিত হতো বিটিভিতে। তবে বিদেশী সিরিয়ালের প্রতি দর্শক ঝোঁক থাকলেও বাংলা নাটক কিংবা ‘ইত্যাদি’ ছিল বাংলাদেশের মানুষের বিনোদনের মূল খোরাক। পরবর্তীতে স্যাটেলাইট কিংবা কেবল অপারেটরদের আবির্ভাব হলে গুরুত্ব কমে আসে বিটিভির। শুরু হয় স্টার টিভির প্রাধান্য। বিদেশী চ্যানেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশেও বেসরকারী টিভি চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়। এক্ষেত্রে একুশে টেলিভিশনের যাত্রা ছিল বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এক যুগান্তকারী ঘটনা। তাদের মানসম্মত গ্রোগ্রাম দর্শককে বাধ্য করে বিদেশী চ্যানেল ভুলে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে। রাজনৈতিক কারণে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দেশীয় দর্শক পুনরায় বিদেশী চ্যানেলের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এই শূন্যস্থান দখল করে ভারতীয় স্টার জলসা ও স্টারপ্লাসের নানা নামের সিরিয়াল। এসব সিরিয়ালের দ্বন্দ্ব-প্রতিহিংসা-ক্ষমতার লড়াই-গল্প বলার ঢঙে মোহবিষ্ট হয় আপামর মানুষ। বিশেষ করে নারী সমাজ। হিন্দী সিরিয়ালের প্রতি গৃহিণীদের আগ্রহ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে দেশীয় ব্র্যান্ড ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে শুরু করে। কি অসাধারণ বাজারজাতকরণ! ভারতীয় চ্যানেলের দৌরাত্ম্যে যখন দেশীয় চ্যানেলের দফারফা অবস্থা এমন সময় দীপ্ত টিভি নিয়ে আসে ডেইলি সোপ ‘সুলতান সুলেয়মান’। তুরস্কের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সিরিয়াল আটটি দেশে ডাবিং করে প্রচারিত হয়। চলতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে এই সিরিয়ালের প্রথম সিজনের প্রচার শুরু হয়। শোনা যায়, বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের পরামর্শে দীপ্ত টিভি চ্যানেল এই সিরিয়াল প্রচার শুরু করে। অটোমান সম্রাজ্যের ইতিহাস-ঐতিহ্যে অনুপ্রাণিত এই গল্পের প্রধান চরিত্র সুলতান সুলেয়মান। যিনি অটোমান সম্রাজ্যের দশম সুলতান। তুর্কী সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে সুলতান বায়েজিদের পাশে তাঁর নাম সমভাবে উচ্চারিত হয়। সুলতান সুলেয়মানকে কেন্দ্র করেই গল্পের টানাপড়েন। তবে এ ক্ষেত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হুরাম সুলতানার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই সিরিয়াল দর্শককে এমনভাবে আকৃষ্ট করে যা অতীতের ম্যাকগাইভারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে দীপ্ত টিভি কর্তৃপক্ষ দিনে তিনবার এই সিরিয়াল প্রচার করে। এই সিরিয়াল ইতিহাসনির্ভর হলেও পুরো গল্প সুলতানের হেরেম অর্থাৎ প্রাসাদের নানা ঘটনা নিয়ে তৈরি। যা আসলে হিন্দী সিরিয়ালের নামান্তর। এই সিরিজ দেখার মনস্তাত্ত্বিক কারণ নিয়ে এখন দুই ধারার গণমাধ্যমেই গবেষণা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাংলার ডাবিং করা বিদেশী সিরিয়াল আনার প্রবণতা। বেশিরভাগ টিভি চ্যানেল এখন দর্শক ধরে রাখতে এই পথে পা বাড়াচ্ছে। এসব ডাবিং করা সিরিয়াল নিয়ে সম্প্রতি শিল্পী সমাজ শিল্প রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছে। টিভি চ্যানেল মালিকরা আন্দোলনরত শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ দাবি কতটুকু যৌক্তিক তা পাঠক বিবেচনা করবেন। তবে বিশ্বায়নের এ যুগে জানালার কপাট বন্ধ রেখে ঘর আলোকিত করা সম্ভব নয়। তা নি:সন্দেহে বলা যায়।
×