ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম পাণ্ডে

নটধা ও ওথেলো থেকে অথৈ

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

নটধা ও ওথেলো থেকে অথৈ

একটি কালো লোককে তার শত যোগ্যতা সত্ত্বেও কীভাবে সাদা লোকেরা আস্তে আস্তে নষ্ট করে দেয়, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার খুব ভাল করে দেখিয়েছেন তার ‘ওথেলো’ নাটকে। মূল ওথেলোকে শুধুমাত্র কথা বলে ভুল বুঝিয়ে তাকে অনিবার্য ধ্বংসের পথে চালিত করে বন্ধু বেশে এসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া ইয়াগো। আপাতভাবে নাটকটি প্রেম ও অপ্রেম নিয়ে হলেও এর অঙ্গে অঙ্গে লেগে আছে ঔপনিবেশিকতা, সাদা চামড়ার আগ্রাসন ও উচ্চবর্ণের চাপের উপখ্যান। কেটে গেছে অনেক বছর। তবুও আজও উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সর্বাধিক অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে একটি ‘ওথেলো’। কেন! তাহলে কি সেই সাদা চামড়ার আগ্রাসন ও উচ্চবর্ণের চাপ কমেনি! আজও কি তা ঘটছে নিয়তই! কথাটি যে সত্য তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। প্রতিদিনের খবরে স্পষ্ট দেশ কালের বেড়া টপকে মানুষ আজও জাত, বর্ণ ও ধর্মের ক্ষমতায়নে হয় ক্ষমতাসীন নয় ক্ষমতাহীন লড়াইয়ে লিপ্ত। শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’ অনুপ্রেরণায় ভারতের হাওড়ার নটধা থিয়েটার তার ৯০তম প্রযোজনায় মঞ্চে এনেছে নাটক ‘অথৈ’। নাটকটির রচনা, সঙ্গীত ও নির্দেশনা দিয়েছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়। রাজধানীর বেইলী রোডের মহিলা সমিতিতে চলমান ‘বটতলা রঙ্গমেলা-২০১৬’ শীর্ষক নতুন নাটকের উৎসবে ‘অথৈ’ নাটকের ১৩তম মঞ্চায়ন হয় সোমবার সন্ধ্যায়। ‘প্রকৃতি ও মানব হত্যার বিরুদ্ধেÑমুক্তির উৎসবে’ স্লোগানে দ্বিতীয়বারের মতো দশ দিনব্যাপী এ উৎসবের আয়োজন করেছে নাট্যসংগঠন বটতলা। ‘অথৈ’ নাটকটি মঞ্চায়নের আগে জনকণ্ঠের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় নটধা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা নাট্যকার ও নির্দেশক শিব মুখোপাধ্যায় বলেন, নটধা তাদের ৪১ বছর চলবার পথে বারবারই সমকাল ও সমসময়ের সঙ্গে নিজেদের রাখতে চেয়ে নাট্যভাষের জন্ম ও সন্ধান করেছে। সেই হাওয়াতেই তৈরি করেছে কখনও গ্রিক বাক্কের অবলম্বনে রাজা পেন্হেউস, কখনো শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, কখনও বা শিব মুখোপাধ্যায় রচিত মহাভারত, পলাশী, শকুন্তলা। এই ৪১ বছরে এসে তাদের নিবেদন ‘অথৈ’। ‘অথৈ’ নাটকের মাধ্যমে ওথেলোকে বাংলায় এনেছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়। একটি গ্রামের প্রেক্ষাপট খুঁজতে চেয়েছেন ভারত তথা বিশ্বজুড়ে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের ভিতরকার রাজনীতিকে। জানাতে চেয়েছেন যে কোন আক্রোশে শুধুমাত্র নিচু জাত হওয়ার দোষে এক উচ্চ জাত তাকে অনায়াসেই নষ্ট করে শ্লাঘা বোধ করে। বাংলা, বিহার কর্ণাটক, কাশ্মীর হয়ে হালের তামিলনাড়ু কিংবা হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি জায়গায় যা ঘটছে তা প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে। প্রতিদিন যে দলিত মেয়ে ধর্ষিত হয়। দলিত বলে পুড়িয়ে মারা বা জনজীবনের সামান্যতম সুবিধা দিতে অস্বীকার করা নিত্যদিনের ঘটনা। ৪১ বছরে নটধার নাট্যান্বেষণে তাই উঠে এলো বাংলা ওথেলো। নাটকের গল্পটি দুই বন্ধুর। অনগ্র ও অথৈ। অনগ্রর বাবা ভীনসুরার দেবতা ব্রতনাথ চট্টোপাধ্যায়। ওর বাবার জমিতে অথৈয়ের মা জন ঘাটত। তার মৃত্যুর পর ব্রতনাথ লোধা অথৈকে এনে তোলেন নিজের বাড়িতে। অথৈয়ের দিদিমাকে ওপারের কুলীনরা ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মেরেছিল। তাই নিজের জাতকে সম্মান দেওয়ানোটা যেন ছিল অথৈয়ের রক্তের গভীরে। অনগ্রর পরা জামা পরে এঁটো খাবার খেয়ে দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ অনগ্রর মা মারা জান। সেই সময় অথৈ ওকে আগলে রাখত বটে। তবে অনগ্রর মন ঘুরতে শুরু করে। সে ভাবতে আরম্ভ করে অথৈয়ের জন্য ওর মা মারা গেছে। ধীরে ধীরে স্কুলে প্রথম হতে লাগল অথৈ ও অনগ্র দ্বিতীয়। মনের মধ্যে কেমন একটা বিষ মিষতে শুরু করল তখন থেকেই। এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। অথৈ ও অনগ্র এখন ডাক্তার। অথৈ পড়া শেষে গ্রামে এসেছে। স্বপ্ন একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা। শামিল ব্রতনাথও। মৃত স্ত্রীর নামে তিনি এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলতে চান। অথৈ ও অনগ্রর কলকাতার মেডিকেল কলেজের স্যার বিভস্বান মুখার্জির মেয়ে দিয়ামনাও এসেছে এই ভীনসুরাতেই। বিলেত থেকে কদিনের জন্য গ্রামে আসা অনগ্র সহ্য করতে পারে না। তার মনে হয় একটা খেলা লেখবে, যে খেলায় অথৈ হারবে আর ও জিতবে। পরিকল্পনা মতো অনগ্র গ্রামের এক উঠতি হিরো এলাকার দাদাভাই রাদুকে ধরে, কারণ এই একমাত্র ভিনসুরাবাদী যে অথৈকে পছন্দ করে না। রাদুকে অনগ্র বোঝায় সে যদি ওর কথামতো চলে তাহলে দিয়াকে পাবার ব্যবস্থা করে দেবে। রাদুকে ধরে অনগ্র একটা পরিকল্পনা করে। অথৈয়ের খুব কাছের একটা ছেলে যে ওর কম্পাউন্ডার, মুকুলকে মদ খাওয়ায় অনগ্র নানা অছিলায় উৎসবের নামে। অনগ্র জানে যে অথৈ মদ ব্যাপারটা একেবারে মেনে নেয় না। মদ্যপ মুকুলের সঙ্গে ছন্ন বিত-ায় জড়ায় রাদু। অথৈকে সেটা দেখায় অনগ্র। প্রচ- রাগে অথৈ মুকুলকে বলে, ওর সঙ্গে আর সম্পর্ক না রাখতে। এদিকে অনগ্র আভাসে ইঙ্গিতে অথৈকে বোঝাতে থাকে দিয়া মুকুলকে ভালবাসে। মুকুল দিয়াকে বলে, ও এই ভুল করে অনুতপ্ত। দিয়া বলে সে অথৈকে বলবে মুকুলকে আবার কাজে ফিরিয়ে নিতে। প্রতিশ্রুতিমতো দিয়া অথৈকে বার বার বলে মুকুলকে ফেরাবার কথা। অনগ্র এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে অথৈর মনটা মুকুল ও দিয়ার বিরুদ্ধে বিষাতে। অথৈয়ের বিশ্বাস পেতে অনগ্র মুকুলের বোন মিলি, যে ওকে ভালবাসে অন্ধের মতো। তাকে দিয়ে অথৈয়ের মার হাতে তৈরি একটা রুমাল ওদের বাড়ি থেকে চুরি করতে বাধ্য করে। এই রুমালটি অথৈ বিয়ের দিন দিয়াকে দিয়েছিল মার স্মৃতিচিহ্ন রূপে। মিলি অনগ্রর প্রতি ভালোবাসায় কোনদিক না ভেবে রুমালটি অনগ্রকে দেয়। অনগ্র রুমালটি দেয় পিঙ্কিকে। পিঙ্কি পেষায় বারবণিতা, মুকুল ভালবাসে তাকে। পিঙ্কি সেই রুমালটি পিঙ্কিকে দেয়। এদিকে অনগ্র বলে, দিয়া মুকুলকে দিয়েছে ওদের ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে। এ সময় মুকুলের হাত থেকে সেই রুমাল অনগ্র অথৈকে দেখায়। অথৈ ব্যাপারটা সত্যি ভাবে। আসলটা হলো পিঙ্কি দিয়েছে মুকুলকে। অথৈর মনে হতে থাকে যে কুলিনদের হাতে বরাবরের মতো আবার ওর জাত ঠকে গেল? ওর সব গুলিয়ে যায়। ওর মনে হয় সব মিথ্যে। কি এক অন্ধতায় দিয়াকে খুন করে বসে। মর্মান্তিক এই মৃত্যুর পর অথৈ সবার থেকে সত্যিটা জানে। এবার ও নিজেকে শেষ করে দেয়। ভিনসুরার আকাশ আর্তনাদ করে ওঠে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন- অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, তূর্ণা দাশ, সুবির গোস্বামী, উপাবেলা পাল, অর্পণ ঘোষাল, সুমিত পাঁজা, জয়দেব ঘোষ, জ্যোতির্ময় প-িত প্রমুখ। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ওথেলো হয়ে উঠল অথৈ, ডেসডিমনা হয়ে উঠল দিয়ামনা, আইগো হলো অনগ্র এভাবেই নাট্যকার ও নির্দেশক অর্ণ মুখোপাধ্যায় তার নাটকটিকে সমসাময়িক করার চেষ্টা করেছেন। অথৈয়ের ভূমিকায় নির্দেশক অর্ণর অভিনয় ছিল অসাধারণ। অনগ্রর চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য যে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন সত্যি অতুলনীয়। একইভাবে দিয়ামনার চরিত্রে তূর্ণা দাশও দেখিয়েছেন তার চরিত্রের কারসাজি। আধুনিক থিয়েটারে স্পেশের সঠিক ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্পেশের ব্যবহার তো শুধু মঞ্চতল নির্ভর নয়, চরিত্রের শরীর, দৃশ্যপট, মঞ্চ ব্যবহার্য সবটাই আওতায় পড়ে। মঞ্চের প্রায় প্রত্যেকটি জোনের সম্ভাবনাকে নাটকের প্রয়োজনে জাগিয়ে তুলেছেন নির্দেশক। নাটকের ছোট ছোট কম্পোজিশন নির্মাণ সবখানেই থিয়েটার মনস্কতার পরিচয় ছিল।
×