ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়ায় মিলল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজী কবিতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

বগুড়ায় মিলল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজী কবিতা

সমুদ্র হক ॥ অতি পুরনো নথির স্তূপে মিলতে পারে অমূল্য রতন। তাই-ই হয়েছে, যা চমক জাগায়। হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। স্বগতোক্তিতে প্রশ্ন ওঠে- ইতিহাসের অমূল্য একটি রতœ এতকাল অযতনে লুকিয়ে ছিল, যা উদ্ধার হওয়ার পরও কিছুকাল যতেœর সঙ্গেই লালিত ছিল। প্রকাশ হয়নি। এ প্রতিবেদনে তা উন্মুক্ত হলো। ১৯৩৫ সাল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন শান্তি নিকেতনে বাস করতেন। জীবনের শেষের অধ্যায়ে তখন তিনি। জীবন সায়াহ্নে যে ঘরখানিতে তিনি থাকতেন তার নাম দিয়েছিলেন ‘উত্তরায়ন’। কবিগুরুর রাইটিং প্যাডেও একটি মনোগ্রামের ডান ধারে লেখা ছিল- উত্তরায়ন, শান্তি নিকেতন, বেঙ্গল। এই রাইটিং প্যাডে তিনি ফাউন্টেন পেনে (ঝরনা কলম) একটি ইংরেজী কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন ভারতবর্ষের ইলাসট্রেটেড ইন্ডিয়া পত্রিকায়। কবিতার কোন শিরোনাম ছিল না। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ১৯৩৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় কবিগুরুর রাইটিং প্যাডে নিজের হাতের লেখা সেই শিরোনামহীন কবিতা হুবহু ছাপিয়ে দেয়। পত্রিকা শিরোনাম দেয় ‘এ পোয়েম বাই রবীন্দ্রনাথ স্পেশালি সেন্ট ফর আওয়ার উইকলি’ (রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা যা বিশেষভাবে আমাদের পত্রিকায় ছাপানোর জন্য তিনি পাঠিয়েছেন)। ইংরেজিতে কবিতাটি এরকম- ÔYes it is my own wish that my seeking may never come to its end I desire not final fruits, for they become a barden when gained. They arrive in their own time, they drop to the dust, they comes the chance for my flowers to blossom anew, Let me not fear the struggle of endeavour and be sure of the giving that is endless and the delight of receiving in constant recurrence. -Rabindranath Tagore এ কবিতাটির অর্থ (ভাব) করলে দাঁড়ায় ‘ইচ্ছা মোর যেন নাহি যায় থেমে/এই মোর আশা/চূড়ান্ত ফল চাই না আমি, সে তো বড় বোঝা/সময়েতে ফল ফলে যায়/তারপর ঝরে পড়ে যায় ধুলায় মিশে/ইহার পরে নতুন ফুলের সূযোগ আসে, নতুন করে ফোটার/চেষ্টা কিংবা লড়াই, এদের করি না ভয়/ত্যাগ আমার নিরন্তর, এই বিশ্বাসে স্থির আমি/প্রাপ্তির আনন্দও ধ্রুব অবিরাম জানি’। কবিগুরুর নিজের হাতের লেখা এ কবিতা ইলাসট্রেটেড ইন্ডিয়া পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর বগুড়ার নওয়াব পরিবারের কোন এক সদস্য সেই পত্রিকাটি কিনে রাখেন, যা থাকে নওয়াব বাড়ির অনেক বই পুস্তক ও পত্রিকা সংগ্রহশালায়, যা স্তূপ হয়ে আছে। এক সময় দেশের প্রতিটি এলাকায় বনেদি পরিবারের বাড়িতে সংগ্রহশালা ছিল, যা ছিল একেকটি মিনি লাইব্রেরি। যেখানে মিলত অনেক মূল্যবান বই-পুস্তক, কাগজের পাতা। বছর কয়েক আগে বগুড়ার গবেষক আব্দুর রহিম বগ্রা নওয়াব বাড়িতে পুরনো দিনের সংগ্রহশালায় প্রবেশাধিকার পান। এ সংগ্রহশালার দায়িত্বে ছিলেন সাইফুদ্দিন আহমদ। তিনি নওয়াব পরিবারের আলতাফ আলী চৌধুরী ও তদানীন্তন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর সংগ্রহ করা পত্রিকা যতেœ রাখতেন। আব্দুর রহিম বগ্রা সেই পত্রিকাগুলো ঘাটতে গিয়ে পেয়ে যান এক অমূল্য রতন। রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা কবিতা হুবহু ছাপা হয়েছে ইলাসট্রেটেড ইন্ডিয়া পত্রিকার ভেতরের পাতায়। আব্দুর রহিম বগ্রা পত্রিকার ওই পাতা যতœসহকারে সংগ্রহের শর্তে সাইফুদ্দিন আহমদের কাছে চান। তা নিয়ে তখনই লেমিনেটেড করে ফটো ফ্রেমের মধ্যে এঁটে ঘরে রেখে দেন। দিনে দিনে তার সংগ্রহশালার অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। দিন কয়েক আগে তিনি এটি খুঁজে পান। কাকতালীয়ভাবে কথা প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে তিনি এ পাতাটির কথা বলেন। তখন কি আর বসে থাকা যায়। বছর কয়েক আগে নওগাঁর পতিসরে কবিগুরুর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের এক ঘরে অনেক কাগজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা আশীর্বাণী খুঁজে পাওয়া যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ৭৬ বছর বয়সে সর্বশেষ নওগাঁর পতিসরে আসেন ১৯৩৬ সালে। এ সময় তিনি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র শিক্ষকদের উদ্দেশে আশীর্বাদ বাণী দেন। রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রাহক ও সাংস্কৃতিক কর্মী এম মতিউর রহমান মানুন এই বাণী খুঁজে পান, যা সংরক্ষিত আছে। সূত্র জানায়, রবীন্দ্র স্মৃতি উদ্ধারে দেশে ৩১ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বাইরে আরও অনেক স্থানে রবীন্দ্রনাথের কোন স্মৃতি থাকতেও পারে। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজীতে লেখা অনেক কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ১৯১২ সালে কবিগুরু যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যে পদধূলি দেন। ইলিনয় রাজ্যের শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত এজরা পাউন্ডের পোয়েট্রি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ছয়টি কবিতা। ১৯৫৩ সালে বিশ্বের মানুষের কাছে রোমান্টিসিজমের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র গ্রেগরি পেক অড্রে হেপবার্ন অভিনীত রোমান হলিডে ছবিতে রবীন্দ্রনাথের অনন্ত প্রেম কবিতার প্রথম দুই পঙ্ক্তি ইংরেজীতে আবৃত্তি করেন গ্রেগরি পেক। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেনÑ ‘তোমারেই যেন ভালো বাসিয়াছি শতরূপে, শতবার জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার...’। যার ইংরেজী হয়েছে ‘আই সিম টু হ্যাভ লাভড ইউ ইন নাম্বারলেস ফরমস, নাম্বারলেস টাইমস, ইন লাইফ, আফটার লাইফ, ইন এজ আফটার এজ ফরএভার।’ কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বকালের। মহাকালের পথ ধরেই যেন তার আবির্ভাব...।
×