শংকর কুমার দে ॥ নজরদারির অভাবে অবৈধ অবস্থানরত বিদেশীরা বেপরোয়া হয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গত সোমবার রাজধানীতে সেলফোনে এসএমএসের মাধ্যমে লটারি জেতার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সাত নাইজেরীয়সহ আটজনের প্রতারক চক্র এক লাখ মোবাইল ফোন গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করার টার্গেট করেছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে র্যাব। এছাড়াও গত এক মাসে অন্তত ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে, যাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াবা মাদক নিয়ে আসার মতো গুরুতর অভিযোগ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অবৈধ বিদেশীরা হত্যা, ডাকাতি, প্রতারণা, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িত বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। অবৈধ বিদেশীর সংখ্যা কত তা নির্ণয় করার জন্য ডাটাবেজ তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের অবৈধ বিদেশীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এছাড়াও মিয়ানমার থেকে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অন্তত ১২টি দেশের দুই সহস্রাধিক নাগরিককে বিভিন্ন সময়ে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে অবৈধ বিদেশীদের অনেকেই অপরাধ করেও জামিন নিয়ে বের হয়ে এসেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানান, গত সোমবার রাতে রাজধানীর রাজধানীর মিরপুর ও দক্ষিণখান থানার আশকোনা থেকে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সাত নাইজেরিয়ানসহ আটজনকে গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতাকৃত ব্যক্তিরা হচ্ছেন উগোচুকু আলফ্রেড (ছদ্মনাম উইলিয়াম), আনুকু ডোনাটুস একওয়েলর, চিদি ইবেউইক, মাইকেল ওনিয়েদিকা এননেজি, ওবুম স্যামুয়েল চুকু দুলু, হেনরি এসিয়াক, আনায়ো ওগাগবা ও আরিফুল। তাদের কাছ থেকে ২২টি সেলফোন, একটি ল্যাপটপ, দুটি মডেম, সাড়ে তিন হাজার নাইজেরিয়ান মুদ্রা, ৩০১ ইউএস ডলার, পাঁচ বাহরাইনের দিনার ও এক লাখ ৪১ হাজার বাংলাদেশী টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। সেলফোনে এসএমএসের মাধ্যমে লটারি জেতার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাত নাইজেরীয়সহ আটজন দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণা করে আসার এক পর্যায়ে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, গত নবেম্বর থেকে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে রাতের আঁধারে। এ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে যার মধ্যে অনেকেই দালাল চক্রের মাধ্যমে ইয়াবা নিয়ে এসেছে। সীমান্তরক্ষীর উদ্বৃতি দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানানো হয়, দিনের বেলায় অনুপ্রবেশের চেষ্টার পরিবর্তে রাতের বেলায় ছোট নৌকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে রোহিঙ্গারা। ইতোমধ্যেই মাদকাসক্ত ৮ জন দালালকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে এসব দালালরা রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে। টেকনাফ সীমান্তের হ্নীলার জাদীমুরা, লেদা, মুচনী, নয়াপাড়া, আলীখালী, দমদমিয়া, হ্নীলা ফুলেরডেইল, কাস্টমস ঘাট, হোয়াব্রাং, মৌলভীবাজার, খারাংখালী, নয়াবাজার, ঝিমংখালী, উনছিপ্রাং, লম্বাবিল, হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, নাজিরপাড়া, সাবরাং, মৌলভীপাড়া, বরইতলী, কেরুণতলীসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বসবাস করছে যাদের অনেকেই নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। এমনকি জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগও আছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে।
পুলিশের একটি সূত্র জানান, দেশে বিদেশী অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সদর দফতর থেকে ৬৪ জেলা পুলিশ সুপার ও সব কয়টি মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনারকে অবৈধ বিদেশীদের তালিকা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ রাজধানীর কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা লুট হওয়ার ঘটনায় একাধিক বিদেশী নাগরিক জড়িত বলে পুলিশ ও র্যাব নিশ্চিত হয়েছে। ওই সব প্রতারককে ধরতে সব কয়টি ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত এলাকার কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। অবৈধ বিদেশীদের ডাটাবেজ তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, অন্তত ১২টি দেশের দুই সহস্রাধিক নাগরিকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর মধ্যে নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিপিন্স, আলজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। ওই সব বিদেশী কোথায় যায়, কী করে, কোন এলাকায় বসবাস করে তার কোন খোঁজ রাখছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এদের বড় একটি অংশই বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে উন্নত দেশের ভিসা দেয়ার পাশাপাশি নাগরিকত্ব করিয়ে দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশের কিছু অসাধু ব্যক্তি এসব বিদেশী নাগরিককে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এসব প্রতারকের খপ্পরে পড়ে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের কাছে জমা হচ্ছে।