ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাবিতে স্মৃতিফলক উদ্বোধন

আধুনিক স্থাপত্য, অনন্য নিদর্শন ॥ ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিচিত্র

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

আধুনিক স্থাপত্য, অনন্য নিদর্শন ॥ ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিচিত্র

মামুন-অর-রশিদ ও কায়কোবাদ খান ॥ উত্তরের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে খ্যাত মতিহারের ছায়াঘেরা সবুজ চত্বরে এবার অত্যাধুনিক স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে নির্মিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক। মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ এবং হাজারো শহীদ বুদ্ধিজীবীকে শ্রদ্ধা জানাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নির্মিত হচ্ছে এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাঁচ শিক্ষকের নক্সায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দক্ষিণ পাশে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন এই স্মৃতিফলক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিচিত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার হারানো ইমেজ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ ড. হাবিবুর রহমান ও মীর আব্দুল কাইয়ূমের ভাস্কর্য ছাড়াও স্মৃতিস্তম্ভে ফুটে উঠবে রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের দেয়ালের আদলে গড়া নতুন কনসেপ্ট। আগামী ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা নিদর্শনের মাধ্যমে স্মৃতিফলকটির উদ্বোধন করা হবে। তার এখন চলছে শেষ পর্বের কাজ। গত আগস্ট মাসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর রাবির চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দিন-রাত পরিশ্রমে দ্রুত এগিয়ে চলেছে এর নির্মাণকাজ। দেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাবিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মিত হওয়ায় এ নিয়ে উৎসাহ বিরাজ করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝেও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকটি। স্মৃতিফলকের মূল বেদির আয়তন ১ হাজার ৭৪০ বর্গফুট। বেদির তিন দিকে ফেন্সি ব্রিক দিয়ে নির্মিত হয়েছে সিঁড়ি। মূল বেদির দক্ষিণ ধারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে নির্মাণ করা হয়েছে ২৬ ফুট দৈর্ঘ্য এবং সাত ফুট প্রস্থের কালো মার্বেল পাথরের বেদি। তার ওপরে ২৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং তিন ফুট প্রস্থের সবুজ বেদি। এই বেদির মাঝ দিয়ে সবুজ ঘাসের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিফলকের প্রধান অংশ সাদা দেয়াল। সাদা সিমেন্ট ও মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এই দেয়ালের উচ্চতা ১০ ফুট, দৈর্ঘ্যে ২০ ফুট। সাদা দেয়ালের পেছনের অংশের দেয়ালে খোদাই করা হয়েছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ’৬২-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের মৃত্যু, দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী সামশুজ্জোহার মৃত্যু, এগারো দফা ও ’৭০-এর নির্বাচনের বিভিন্ন চিত্র। সামনের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চে জাতির জনকের ভাষণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার কিছু ইমেজ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ ড. হবিবুর রহমান ও মীর আব্দুল কাইয়ূমের ভাস্কর্য। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাবির তিন অধ্যাপকের স্মরণে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক তৈরির পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। গত দুই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে তিন বুদ্ধিজীবীর ছবি টাঙিয়ে অস্থায়ী স্মৃতিফলক নির্মাণ করে বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাঁচ শিক্ষক স্থায়ী স্মৃতিফলকের নক্সা তৈরি করেন। গত বছরের ১৫ জুন সিন্ডিকেটে নক্সার অনুমোদন দেয়া হয়। এ সময় স্মৃতিফলক নির্মাণে শিল্প পরামর্শক কমিটি এবং আর্কিটেকচারাল ডিজাইন কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৪ আগস্ট আম ও লিচু গাছের ছায়ায় ঘেরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দক্ষিণে স্মৃতিফলকটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন। এরপর অক্টোবরের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা জিমনেশিয়ামে স্মৃতিফলক নির্মাণের মূল কাজ শুরু হয়। বিরাট এই কর্মযজ্ঞের ছাঁচ তৈরির মূল কাজটা করেছে রাবির মহিলা জিমনেশিয়ামে। তারপর ছাঁচ খুলে নিয়ে এসে স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য দেয়ালের কাঠামো সাজিয়ে ঢালাইয়ের কাজ করা হয়। এরই মধ্যে গত বুধবার সাদা দেয়াল ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়। এরপর বেদি এবং মূল বেজমেন্টের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ১৪ ডিসেম্বর এখানে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে স্মৃতিফলকের উদ্বোধন হবে। তবে এরপরও স্মৃতিফলক নির্মাণের কিছু কাজ বাকি থাকবে। আগামী ৭ মার্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুসহ রাবির শহীদ তিন বুদ্ধিজীবীর মেটালের যে ভাস্কর্য হবে সেগুলা তৈরি করে দেয়ালে সংযোজন করা হবে। বর্তমানে বাকি কাজ শেষ করতে সকাল থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত কাজ করছেন চারুকলা অনুষদের ১০-১২ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের সার্বিক কাজ দেখাশোনা করছেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষক এবং শিল্প পরামর্শক কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ঋতেন্দ্র কুমার শর্মা, অধ্যাপক ফজলুল করিম, ড. সুভাষ চন্দ্র সূতার, একেএম ময়নুল ইসলাম ও কনক কুমার পাঠক। তাদের সহযোগিতা করছেন মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষার্থী অনুপম, তাপস, জিনাত, মিলন, সুভাস এবং ক্লে-মেকার মদন কুমার। মঙ্গলবার রাতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের স্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিভাগের চার পাঁচজন শিক্ষার্থী সাদা দেয়াল তৈরির জন্য একটার পর একটা ছাঁচ সাজাচ্ছেন। তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ফজলুল করিম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের দেয়ালের একটা কনসেপ্টে এ স্মৃতিফলকটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বধ্যভূমির সিম্বলগুলো এতে ব্যবহার করা হয়েছে। স্মৃতিফলক দেয়াল তৈরিতে এত ফিগারেটিভ কাজ দেশের আর কোথাও হয়নি। দেয়ালে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন চিত্র খোদাইয়ের পাশাপাশি মেটাল রে ট্রান্সফার এবং মেটাল যোগ করা হয়েছে। রিলিফ মেটালে এমন কাজ আর কোথাও নেই। কাজটা দাঁড়ালে সবাই দেখতে পাবেন। স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প পরামর্শক কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ঋতেন্দ্র কুমার শর্মা বলেন, এটাতো নিজের কাজ। ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক না হলেও প্রাণের টানে শখেরবশে এই কাজ করছি। ভাল লাগা না থাকলে এটা কী করা যায়!
×