ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চাচার সেই কথা আজও ভুলিনি- সাক্ষাতকারে মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস

‘স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবে’

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

‘স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবে’

খোকন আহমেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টার দিকে আমরা যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকার বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছলে পাক সেনারা আমাদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। একমাত্র রাইফেল নিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন আমাদের দলনেতা নুরুল হক হাওলাদার। তিনি আমার বড় চাচা। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে পাশের ক্যাম্পে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করে। শরীরে একাধিক বুলেট নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় চাচা আমাদের একটা কথাই বলেছিলেন, যতক্ষণ দেশ স্বাধীন না হয় ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চাচার মৃত্যু হয়। তবে চাচার সেই কথা আজও ভুলতে পারি না। জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই যুদ্ধদিনের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করাসহ একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে মুক্তিকামী এলাকার যুবকদের একত্রিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর অপরাধে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার হস্তিশু- গ্রামের সামচুল হক হাওলাদারের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিনকে হারাতে হয়েছে তার বড় চাচা নুরুল হক হাওলাদারকে। যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাবার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়াদিয়ে দেশ মাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমরা ৩০ জনের একটি দল তৎকালীন বিমান বাহিনীর অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক নুরুল হক হাওলাদারের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম। নুরুল হক হাওলাদার আমার বড় চাচা। ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টার দিকে আমরা যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকার বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছলে পাক সেনারা আমাদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। এ সময় চাচার কাছে শুধু একটি রাইফেল ছিল। আমাদের জীবন বাঁচাতে নিরাপদে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ওইসময় তিনি পাক সেনাদের ওপর পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে পাকিদের ছোড়া বুলেটে গুলিবিদ্ধ হন চাচার ও আবুল হোসেন নামে আরেক জন। ওইসময় আমরা প্রাণ বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী ডোবার কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়েছিলাম। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, গোলাগুলির শব্দ পেয়ে বয়রা ক্যাম্পের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাল্টা আক্রামণ চালালে পাক সেনারা পিছু হটে পালিয়ে যায়। বেশ কিছুসময় গুলির শব্দ না পেয়ে আমরা ডোবা থেকে উঠে দেখি পাকিদের বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাসিমুখে দেশের তরে ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন। আর আমার চাচার শরীরে একাধিক বুলেট এসে আঘাত করায় তিনি রক্তাক্ত জখম হয়ে ছটফট করছেন। তখন আমি ও বয়রা ক্যাম্পের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা নুরুল হক চাচার কাছে এগিয়ে যাই। ওইসময় ছটফট করতে করতে আমার উদ্দেশে চাচা একটা কথাই বলেছিলেন, যতক্ষণ দেশ স্বাধীন না হয় ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এই কথা বলার পর পরই তিনি অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরে তাৎক্ষণিক ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশে তার সহযোদ্ধারা তড়িঘড়ি করে নুরুল হককে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ভারতের ব্যারাকপুর হাসপাতালে নিয়ে যান। আর ঘটনাস্থলেই শহীদ হওয়া আবুল হোসনকে আমরা সেইদিন বয়রা ক্যাম্পের মধ্যেই দাফন করি। তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাপ্টেন হুদা আমাদের ভারতের বিরভূম ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। আমরা ওই ক্যাম্পের ১৩তম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। এ ঘটনার দুইদিন পর (৮ সেপ্টেম্বর) প্রশিক্ষণরত অবস্থায় আমরা জানতে পারি আমাদের নুরুল হক চাচা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। যার নেতৃত্বে ও অনুপ্রেরণায় দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ঘর ছেড়েছি, সেই নুরুল হক চাচাকে হারিয়ে আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করি। ট্রেনিং শেষে মেজর এম.এ জলিলের সাথে সাতক্ষীরা এলাকা দিয়ে দেশে প্রবেশ করেই একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকার একটি যুদ্ধে পাকসেনাদের নিক্ষেপ করা গ্রেনেডের স্পিøন্টার আমার বাম পায়ে আঘাত হানার পর কয়েকদিন আমি স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করি। কয়েকদিন পর আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে পূনরায় দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ছিনিয়ে এনেছি সবুজে রক্তে লাল বিজয় পতাকা। মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন জানান, দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার বড় চাচা তৎকালীন বিমান বাহিনীর কর্পোরেট অফিসার নুরুল ইসলাম ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম.এ জলিলের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় তার নির্দেশে তিনি (নুরুল হক) একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে গ্রামের যুবকদের একত্রিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতেন। এছাড়া পূর্ব প্রশিক্ষণ থাকায় তিনি রহমতপুর এলাকায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করেন। এজন্য স্থানীয় রাজাকার ফজলে কারিকর ও শিকারপুর এলাকার শীর্ষ রাজাকার গফুর মৃধার মদদে পাক সেনারা নুরুল হক হাওলাদারকে হত্যার উদ্দেশে তার হস্তিশু- গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। ওইসময় বাড়িতে কাউকে না পেয়ে হায়েনারা তার ঘরে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। হস্তিশু- গ্রামে এটাই প্রথম পাক সেনাদের হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এরপর থেকেই পরিবার-পরিজনকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে মুক্তিযুদ্ধের দক্ষ সংগঠক হিসেবে নুরুল হক হাওলাদার গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে দল গঠন করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতেন। স্মৃতির পাতার সেই দুঃসহ কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বার স্তব্দ হয়ে চোখে জমে ওঠা জল মুছে নিচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার। দীর্ঘ ৪৫ বছর আগের কষ্টের কথা তাকে যেন আবার নতুন করে পীড়া দিচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের উত্তাল ওই মুহূর্তে কর্মের সুবাধে শ্রমিক হিসেবে আমি খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলে ও আমার ছোট ভাই আলমগীর হোসেন সোনালী জুট মিলে কর্মরত ছিলাম। ওইসময় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশমাতৃকার টানে মুক্তিবাহিনীতে যোগদিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের দুইভাইকেই খবর পাঠিয়েছিলেন চাচা নুরুল হক হাওলাদার। তার খবর পাওয়ার পর আমরা দুইভাই-ই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী ছোট ভাই আলমগীর হোসেনকে আগে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওকে বলে দিয়েছিলাম, আমাদের বাবা ও মাকে কিছু না জানিয়ে গ্রামে ফিরেই নুরুল হক চাচার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি আরও জানান, আলমগীর চাচার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি আলমগীরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, দেশ আজ তোমাদের মতো বীর সন্তানদের অপেক্ষায়। বাবা তোমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করো। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে সরকারী অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল ও উজিরপুরের দশজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে উপজেলা পরিষদের সামনে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। ওই ফলকের প্রথম নামটি ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল আটটার দিকে যশোরের কালীগঞ্জের বয়রা এলাকায় পাক সেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হওয়া আবুল হোসেন হাওলাদারের। দ্বিতীয়স্থানের নামটি হচ্ছে আমার চাচা নুরুল হক হাওলাদারের। আমাদের বড় চাচা নুরুল হক হাওলাদার দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন। নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন। অথচ চাচার পরিবারের সদস্যরা খুবই সমস্যার মধ্যে দিন পার করছেন।
×