ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ওরা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক;###;নেই আইনের সুরক্ষা, নেই জীবনের নিরাপত্তা, মেলে না শ্রমের মূল্য;###;শ্রমিকদেরও তাদের অধিকার সম্পর্কে কোন ধারণা নেই;###;তাদের সুরক্ষা দেয়ার আসলে কেউ নেই

পাঁচ কোটির জীবনে শুধুই শূন্যতা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

পাঁচ কোটির জীবনে শুধুই শূন্যতা

রশিদ মামুন ॥ ৬ মার্চ-২০১৬, রাজধানীর কাফরুল এলাকার ন্যাম গার্ডেনের ৩ নম্বর ভবনের সামনের রাস্তা। সকাল সাড়ে ৯টায় এক গৃহপরিচারিকার লাশ পাওয়া গেল। পনেরো বছরের গৃহকর্মী জনিয়া মায়ের অনুপস্থিতির কারণে ভবনের ৪০৩বি-ফ্ল্যাটে সপ্তাহখানেক ধরে কাজ করছিল। জনিয়ার বাবা উসমান গনি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। জনিয়ার লাশের সুরতহাল রিপোর্টে পুলিশ উল্লেখ করে ধারণা করা হচ্ছে মেয়েটিকে কেউ ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। মেয়েটির স্যান্ডেল ছাদে পাওয়া গেছে। মেয়েটির ডানহাত থেঁতলানো ও রক্তাক্ত ছিল। হাঁটুতে আঘাতের চিহ্ন, মুখ রক্তাক্ত ও ওড়না দিয়ে বাঁধা ছিল, নাক রক্তাক্ত ও বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি স্রেফ আত্মহত্যা। জনিয়ার গল্পের শেষ এখানেই। ওসমান গনি আর ফুলবানুর অশ্রুই চিরদিনের সাথী হয়ে রইল। আবার ৫ ডিসেম্বর সকাল ৬টা। রাজধানীর রামপুরা কাঁচা বাজার এলাকা। ঝুড়ি কোদাল নিয়ে বসে আছেন একদল মানুষ। হয়ত একটু পরেই কেউ আসবেন। দাম দর হবে এরপর কাজ মিলবে। সন্ধ্যায় চাল-ডাল কিনে ঘরে ফিরবেন। রাতটুকু কাটাবেন আবার সকালে এই রামপুরা বাজার নয়ত অন্যকোন জায়গাতে। এদের একজন আকবর। তিনি এভাবে কাজ করছেন ১২ বছর। জানালেন রোজই কাজ পাওয়া যায়। কোন কোন সময় কয়েক দিনের জন্যও কাজ মেলে। বেশিরভাগ সময়ে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে তিনি কাজ করেন। একেবারে শেষ দিকের কর্মী তিনি। শ্রমিক আইন শ্রমিক সুরক্ষা এসব সম্পর্কে ধারণা নেই তাঁর। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, এসব বুঝি না, জানিও না। এই হচ্ছে দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের হালচাল। তাদের জন্য আইনে যেমন সুরক্ষা নেই, জীবনেরও তেমন নিশ্চয়তা নেই। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবেই মর্যাদা দেয়নি শ্রম আইন। সরকার ২০১৩ সালে শ্রমশক্তি বিষয়ে যে জরিপ চালিয়েছিল তা ধরে হিসেব করলে দেখা যায় দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ কোটির উপরে। মোট শ্রমিকের ৮৩ দশমিক ৪ ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক। সরকারের তিন বছর আগের হিসেবে দেখা যায় দেশে মোট শ্রমিক রয়েছে ৬০ দশমিক ৭ মিলিয়ন। এরমধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ দশমিক ৮ মিলিয়ন। পুরুষের পাশাপাশি দেশের নারীদের বড় একটি অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন পুরুষ আর নারীর সংখ্যা ১৫ দশমিক ২ মিলিয়ন। সরকারের হিসাবের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পরিসংখ্যান বলছে, দেশে পুরুষদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৫ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক এবং ৮৫ দশমিক ৫ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে। তবে নারীদের মাত্র আট শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক আর বাকি ৯২ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক। যদিও দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের ফলে নারী শ্রমিকদের কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠানভুক্ত হয়েছে। এডিবি বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের দক্ষতা তৈরি হয়। এতে শ্রমিক চাকরি হারালে আবার চাকরি পায়। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের কোন দক্ষতা তৈরি না হওয়ায় তারাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজ পাওয়া জটিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে শ্রমিকরা শোষণের শিকার হন। তিনি গবেষণায় দেখানো হয়েছে এই খাতের শ্রমিকরা পদে পদে শোষণের স্বীকার হন। এখানে নারী এবং পুরুষের মধ্যে মজুরি বৈষম্য প্রকট। দুর্ঘটনার স্বীকার শ্রমিকের প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যয় কোন কোন মালিক বহন করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিক তা বহন করে না। স্থায়ীভাবে শ্রমিকের কোন ক্ষতি হলে তার ভার শ্রমিককে বহন করতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্রমিক দুই/চার দিন কাজে আসতে না পারলে তার যায়গাতে নতুন কেউ কাজ করছেন। শহর এবং গ্রামে এ ধরনের ৩৫টি পেশা রয়েছে যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা কাজ করছেন। এসব খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণেরও কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। আবার শ্রমিকদের দক্ষতার উন্নয়ন বা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ও নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও বাংলাদেশের মধ্যম আয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে শ্রমিকদের উন্নয়নের একটি মান নির্ধারণ করে দিয়েছে। সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শ্রমখাতের উন্নয়ন করা। আগামী সমপ্তাহে আইএলও প্রধান ঢাকা আসছেন। এই সময়ে ঢাকা ঘোষণায় শ্রমিকের মান উন্নয়নের বিষয়টি উঠে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। দেশের মোট শ্রম শক্তির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। যার মধ্যে কৃষি, নির্মাণ, গৃহ, পারিবারিক ব্যবসা, চাতাল, ইটভাটা, গ্যারেজ, স্থল ও নৌ বন্দর, পরিবহন খাত, আসবাবপত্র তৈরি, স’মিল, কাঠমিস্ত্রি, ঝালাই, অটোমোবাইল, দোকান, হোটেল-রেস্তরাঁ, মৎস্য ও গবাদিপশুর খামার, পোল্ট্রি, প্যাকেজিং, কেমিক্যাল কারখানা, প্লাস্টিক কারখানা, ওষুধ শিল্প, স্বনিয়োজিত ইত্যাদি ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। এ ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকারকে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস্-এর এক গবেষনায় দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের সমস্যার জন্য ৮টি কারণকে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব হচ্ছে সস্তা ও সহজলভ্য শ্রমবাজার, আইনগত শিথিলতা, সীমাবদ্ধতা এবং কার্যকর আইনের অভাব; শ্রমিক সংগঠন বা কোন ট্রেড ইউনিয়নের অভাব, মালিক পক্ষের সদিচ্ছা কিংবা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব; মালিক, ঠকাদার, উপ-ঠিকাদার পক্ষের অধিক মুনাফা অর্জনের মনোবৃত্তি; শ্রমিক আধিক্য থাকায় উপযুক্ত মজুরি না পাওয়া; সুনির্দিষ্ট কোন আইনের প্রয়োগ না থাকায় মালিককে মজুরি এবং ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে বাধ্য করা যায় না; শ্রমিকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করে বলে সংগঠিত হতে পারে না। কর্মসংস্থানের জন্য কাজের স্থান বা এলাকা পরিবর্তন করা। অর্থাৎ সবক্ষেত্রেই দেশের বড় শ্রমগোষ্ঠীকে অনিশ্চয়তা নিয়েই চলতে হয়। নিম্নতম মজুরি বোর্ড দেশের শিল্পখাতের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে। তবে সরকার কোন খাতকে শিল্পখাত হিসেবে ঘোষণা না করলে মজুরি বোর্ড ওই খাতের মজুরি নির্ধারণ করতে পারে না। আবার মজুরি বোর্ডও স্বউদ্যোগে কোন খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করতে পারে না। এখনও পর্যন্ত ৪২টি খাতে মজুরি নির্ধারণ করে বোর্ড। এই সমস্যা থেকে কিভাবে উত্তরণ সম্ভব জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ইকতেদার আহমেদ বলেন, আমরা আরও ৩৪টি খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিলাম। এটি করা হলে অনেক খাতই অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। এতে সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে। তবে ব্যাপক এই সমস্যা খুব সহজেই সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। এসব শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় শ্রম আইনকেই প্রতিবন্ধকতা বলা হচ্ছে। কারও কারও মতে, শ্রম আইন আধুনিক হলেও এতে সংবিধান ও জাতীয় শ্রমনীতি ২০১২ এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও আইএলও কনভেনশনের ৮৭ ও ৯৮ ধারা প্রতিফলিত হয়নি। নীতিগতভাবে সকল শ্রমজীবী মানুষকে শ্রম আইনের সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার থাকলেও শ্রম আইনে প্রদত্ত শ্রমিক এর সংজ্ঞায় সকল শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে লাখ লাখ প্রকৃত শ্রমিক শ্রম আইনের সুরক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। দেশের বেশিরভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিককে আমাদের শ্রম আইন শ্রমিক হিসেবেই বিবেচনা করে না। যেহেতু শ্রমিক হিসেবেই বিবেচনা করে না। তাই তার সুরক্ষার বিষয়েও শ্রম আইনে কিছু উল্লেখ নেই। শ্রম পরিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের ৪৫টি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে শ্রম আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এর বাইরে আরও বহু খাত রয়েছে যেগুলোর শ্রমিকদের নিয়ে কাজই করে না শ্রম পরিদফতর। তবে শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে একটি শ্রমিক কল্যাণ তহবিল রয়েছে যেখান থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। এই তহবিল থেকে সাধারণত কোন শ্রমিকের সন্তানের শিক্ষা বৃত্তি, চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়। তবে তৃণমূলের শ্রমিক এই সুবিধা কতটা পায় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে আসা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস্-এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রথমত অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের একটি আইনের আওতায় আনতে হবে, দ্বিতীয়ত তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করতে হবে, তৃতীয়ত তার কাজের মান উন্নত করতে হবে। রিক্সাওলার কাছ থেকে সিটি কর্পোরেশন কর নেয়। কিন্তু রিক্সাওলারতো এই শহরে বসার যায়গা নেই, দাঁড়াবার যায়গাও নেই। তিনি বলেন, আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছি। কিন্তু এখন শ্রমিক যদি তার অধিকার না পায়, না খেয়ে থাকে, তার মান উন্নত না হয় তাহলে এই অর্জন সার্থক হবে না।
×