ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সরওয়ার হক চৌধুরী

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ...

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ...

আমার এক আত্মীয় রংপুর থেকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই আজ জেলা শহরের মানুষও উন্নত চিকিৎসাসেবা হতে বঞ্চিত। কারণ ঢাকায় অবস্থানরত একজন নামী-দামী চিকিৎসক তার একটি বড় ধরনের অপারেশন করেছিলেন। সেজন্য প্রথমত তাকেই দেখানো হলো। কয়েকটি টেস্টের মাধ্যমে জানা গেল, যে বিষয়ে অপারেশন হয়েছে সেটি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। পরবর্তীকালে অন্য এক চিকিৎসকের কাছে দেখানোর পরামর্শ দেয়া হয়। পরামর্শ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে দেখানো হয়। রোগীকে দেখানোর পরদিনই আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় রোগীর ভাই সেই চিকিৎসককে টেলিফোন করলে তিনি বলেন, আপনি অমুক ক্লিনিকে ভর্তি করেন, আমি একবার গিয়ে দেখে আসব। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ অথচ তাৎক্ষণিকভাবে কোন রকম চিকিৎসার কথা না বলে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তির পরামর্শ দেয়া এবং কখন দেখবে তারও কোন ঠিক নেই- পুরো বিষয়টি সবাইকে হতাশ ও বিস্মিত করে। নামকরা ক্লিনিকে ভর্তি করার পরও অযতেœ ও অবহেলা এবং সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে রোগী আরও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। যা হোক আমাদের পবিত্র সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবার এহেন করুণ অবস্থা আমাকে বিস্মিত ও হতাশ করেছে। চিকিৎসার অব্যবস্থা হতে মুক্তি পেতে সর্বপ্রথম সরকারী হাসপাতালগুলোর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের দালাল রোগীদের চরম বিপাকের মধ্যে ফেলে থাকে। এমনকি এসব কর্মকা-ের সঙ্গে অনেক চিকিৎসক, ওয়ার্ড বয়, নার্স এবং লোকাল মস্তানরা পর্যন্ত জড়িত থাকে। আর এই দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে গ্রামীণ পরিবেশ থেকে আসা অসহায় সহজ-সরল মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এই অবস্থা হতে মুক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অত্যন্ত কঠোরভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যা হোক, তার পরও কষ্ট করে সরকারী হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবার অমনোযোগিতা, রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ, সময়ের অভাব, অপরিষ্কার পরিবেশসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীর জন্য রান্নাকৃত খাবার অত্যন্ত নিম্ন মানের। অনেক সরকারী হাসপাতালের খাবার বাইরে বিক্রি করার মতো অভিযোগও রয়েছে। আর এসব অনিয়ম ও অসাধুতা রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে ভর্তি হতে বাধ্য করায়। গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা বা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে চিন্তা বা চেতনা থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের আগের টার্মে গ্রামীণ জনপদে প্রায় ১১ হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে এই কল্যাণকর কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। তাই বর্তমান সরকারের আমলে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর ব্যবস্থা করে গ্রামীণ জনপদে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা বা স্বাস্থ্য পরিচর্যা যেন নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিচর্যা বা স্বাস্থ্যসেবার মান কি পর্যায়ে তা বিগত দিনের জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম উপস্থাপন করলেই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। ২০১২ সালের দিকে ঢাকা শহরের একটি নামকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আমার স্ত্রীর স্ক্যান (চঊঞ ঝঈঅঘ) করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়ে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালের একজন কনসাল্টটেন্টকে সেই স্ক্যানের রিপোর্ট দেখালে তিনি হতাশ হয়ে বলেন, ছবির সঙ্গে রিপোর্টের কোন মিল নেই। তাই তিনি সেই রিপোর্ট গ্রহণ করেননি। এ রকম ঘটনা অহরহই ঘটছে। এই ঘটনা শুনে বাংলাদেশের একজন নামকরা চিকিৎসক বলেন, বাদর দিয়ে হাল চাষ করা যায় না। সম্প্রতি আমি নিজে এবং আমার বড় বোন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা শহরের একটি নামকরা হাসপাতালে ভর্তি হই। আমার সৌভাগ্য যে দক্ষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞের অধীনে ভর্তি হই। তার সুষ্ঠু এবং সঠিক চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। এ রকম দক্ষ ও ভাল চিকিৎসকও বাংলাদেশে আছেন। তবে সেই মেডিসিন বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতিতে হাসপাতালে যে সব ডাক্তার দায়িত্বরত থাকেন তাদের বাস্তব অবস্থা চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো যাবে না। একই অবস্থা সেবিকাদেরও। আমার বোনের ডায়াবেটিস নেই অথচ দায়িত্বরত সেবিকা তাঁকে ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়ার জন্য এগিয়ে যায়। সেবিকা অন্য কেবিনের ফাইল দেখে ওই কাজটি করছিলেন। ঢাকা শহরের একটি নামকরা হাসপাতালের যদি এই অবস্থা হয় তা হলে সাধারণ হাসপাতালগুলোর অবস্থা কি? আমি আমার স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাই। একটি সরকারী হাসপাতালে দেখতে পাই যে, সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সর্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। তারা প্রতিটি রোগী এবং রোগীর এটেন্ডেন্টদের হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান সম্পর্কে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন এবং অভিযোগ, সমস্যা ও অসুবিধা সম্পর্কে জানতে চান। বাংলাদেশেও এ রকম মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত। শুধু সরকারী হাসপাতালে নয়, বেসরকারী হাসপাতালগুলোকেও একটি নীতিমালার মধ্যে আনা উচিত। সেবাদানের মাধ্যমে হাসপাতালগুলো আর্থিকভাবে অবশ্যই লাভবান হবে, তবে চিকিৎসা সেবার নামে বাণিজ্য করা চলবে না। মোহাম্মদপুর, ঢাকা থেকে
×