ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাঙ্গেরি সফর ও কোল্ড লেডি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

হাঙ্গেরি সফর ও কোল্ড লেডি -স্বদেশ রায়

প্লেন ও ট্রেন যাত্রার সুবিধা হলো, কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা থাকে না। বরং সুন্দর পরিবেশে বসে বই পড়া ও লেখালেখি করা যায়। হাঙ্গেরির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘রাঙা প্রভাত’ নামের বাংলাদেশ বিমানটি ছাড়ার কয়েক মিনিট পরেই একটা উপন্যাসে ডুবে যাই। আগে কিছু দূর পড়া ছিল তাই দুই ঘণ্টায় সেটা শেষ হয়ে যায়। নতুন আরেকটা উপন্যাস বের করতে গেলে পাশে গভীর ঘুমে মগ্ন, স্থানীয় সরকার সচিব মালেক সাহেবকে ডিস্টার্ব করতে হয়। তার মতো একজন হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আইপ্যাডটি নিয়ে সাউথ এশিয়ান মনিটরের জন্য একটা লেখা শুরু করি। আশপাশে অধিকাংশই ঘুমাচ্ছেন তাতে বড় নিরিবিলি পরিবেশ এক ঘণ্টার ভেতর এক হাজার শব্দের বেশি লেখা হয়ে যায়। সাউথ এশিয়ান মনিটরের সম্পাদকীয় নীতি, লেখা হতে হবে এক হাজার শব্দের মধ্যে। তাই লেখাটি এডিট করে শব্দ কমানোর প্রস্তুতি নেয়ার আগে মনে করি, একবার রেস্টরুম থেকে আসি। কারণ, আরও পাঁচ ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে কাজের জন্য। রেস্টরুম থেকে ফেরার সময় দেখি প্রধানমন্ত্রীর বসার কিউবিকের পর্দার সবটুকু আটকে দেয়া হয়েছে। প্রথমবার রেস্টরুম থেকে আসার পথে কিছুটা খোলা ছিল, সালামও দেই সেই পথে। এখন পুরোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা। বুঝতে পারি তিনি ঘুমাচ্ছেন বা হয়ত কোন কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সিটের পেছনের সারিতেই তাঁর এমএসপি বসে ওই সোজাসুজি মাঝের রো এ বসা তাঁর সিকিউরিটি প্রধান। তার পরের রোতেই আমরা। স্বাভাবিকভাবে আমার সামনের দিকেই প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর সিকিউরিটি ও অন্যমন্ত্রীরা। যা হোক, সিটে ফিরে বসতেই দেখি বেশ দ্রুততার সঙ্গে সিকিউরিটি অফিসার সামনের দিকে গেলেন। যে দ্রুততায় গেলেন, অত দ্রুততার সঙ্গে কেউ রেস্টরুমে যান না। এ কারণে ধরে নেই, সিকিউরিটি প্রধান তো হয়ত কোন কাজে ককপিটে যাচ্ছেন। যেমন দ্রুততার সঙ্গে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুততার সঙ্গেই তিনি ফিরে এলেন। ফিরে এসে এমএসপির কাছে বেশ নিচু হয়ে কি যেন বলেন। তার পর তারা দুজন কিছুটা দ্রুতই প্রধানমন্ত্রীর বসার কিউবিকের পর্দা সরান এবং তার সঙ্গে নিচু হয়ে কিছু একটা বলেন। প্রধানমন্ত্রী অতি স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়ালেন এবং দুজনকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে গেলেন। ওইভাবে স্বাভাবিক ও শান্ত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে সামনের দিকে যেতে দেখে মনে করি, তিনি নিশ্চয়ই আগের থেকে এনাদের বলে রেখেছিলেন, ওই সময়ে তিনি ককপিটে যাবেন বাইরের দৃশ্য দেখতে- তাই হয়ত ককপিটে গেলেন। আর সিকিউরিটি প্রধান ও এমএসপির ব্যস্ততাকে মনে করি তাদের নিয়মানুবর্তিতা। কাজের জন্য কেবল আইপ্যাডটিতে হাত দিতে যাব এর ভেতর দেখি প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসছেন। একেবারেই স্বাভাবিক চোখ মুখ। ১৯৮১ থেকেই তাঁর এই চোখ মুখ পরিচিত। এখন যদিও উনি কথায় কথায় বলেন, আমার বয়স হয়েছে সত্তর, বাস্তবে সেই বয়সের ছাপ কিন্তু ওনার মুখে পড়েনি। কপালে বা কোথাও কোন বলিরেখাও দেখা যায় না। তাই তাঁর কপালে কোন বলিরেখা বা কুচকানো কোন চিন্তার রেখাও দেখিনি। একেবারে স্বাভাবিকভাবেই উনি তাঁর সিটে ফিরলেন। ফলে মনে কোন প্রশ্ন জাগল না, কেন এত দ্রুত তিনি ককপিট থেকে ফিরে এলেন। বাস্তবে আমার মতো রিপোর্টারের প্রশ্ন এত গভীরে যাওয়ার কথা নয়, আতাউস সামাদ হলে হয়ত চিন্তা করতেন। তবে এমএসপি ও সিকিউরিটি প্রধানের ভেতর কোথায় যেন একটু অস্থিরতা দেখতে পাই। যে অস্থিরতা একবার অবশ্য মনে প্রশ্ন তুলেছিল, ভেবেছিলাম এমএসপি ভদ্রলোকের কাছে যাই। এসব ভাবতে ভাবতে আরও দশ মিনিট কেটে যায়, হঠাৎ সিট বেল্ট বাঁধার সিগন্যাল দেখতে পাই। সিগন্যাল দেখেই মনে করি, গভীর ঘুমে থাকা ভদ্রলোক ও বিনয়ী মানুষ স্থানীয় সরকার সচিবকে ডাকি। কিন্তু তাকে ডাকতে যাওয়ার আগেই কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল, যাত্রী সাধারণের উদ্দেশে ঘোষণা, তারপরেই ঘোষণাটি- ‘আমাদের বিমানে সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে, আমরা পনেরো মিনিটের ভেতর তুর্কমেনিস্তানের আসাগাবাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করব।’ ঘোষণাদানকারী ক্যাপ্টেনের গলা ছিল অতি স্বাভাবিক, তাই এ ঘোষণা অন্তত আমার মনের ভেতর কোন ভয় সৃষ্টি করেনি। মনে করি হয়ত কোন সাধারণ ত্রুটি দেখা দিয়েছে, তারা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কোন রিস্ক নেবে না তাই এখানে জরুরী অবতরণ করছে। বরং মনে মনে ভাবি, তাহলে কি তুর্কমেনিস্তান থেকে দিল্লী হয়ে ফিরে যেতে হবে- না হাঙ্গেরিতে যাব। যা হোক, আমার ঘড়িতে আমি বাংলাদেশ সময় বদলাইনি তাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বাংলাদেশ সময় দুটো বিয়াল্লিশ মিনিটে আমরা তুর্কমেনিস্তানের আসাগাবাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করি। অবতরণের আগ মুহূর্তে আমি নিজে কিছুটা ভয় পাই। কারণ, আমাদের প্লেনটি ভূমির কাছাকাছি নিচুতে আসতেই দেখতে পাই প্রচুর ফায়ার আর্মড কার ও এ্যাম্বুলেন্সে ভরা এয়ারপোর্টটি। তখন ধরে নেই প্লেনটি ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে যে ধাক্কা লাগবে তাতে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তখন মনে মনে শুধু কামনা করি, আমাদের দক্ষ সিকিউরিটি কর্মকর্তারা ও প্লেনের ক্যাবিন ক্রু সবাই মিলে যেন প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপদে বাইরে নিতে পারেন। সে কাজটি যেন তারা দক্ষতার সঙ্গে করেন। আর নিজের সম্পর্কে তখন যা ঘটে তা সত্যই বলছি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে একমাত্র ছেলের মুখটি। মনে মনে তখন হিসাব করি, আমি পিতৃহারা হয়েছি ২৬ বছর বয়সে। ওকে পিতৃহারা হতে হবে ২১ বছর বয়সে। অর্থাৎ আমার থেকেও পাঁচ বছর আগে। পাশাপাশি ভাবি আমার মায়ের থেকে ওর মা অনেক বেশি শিক্ষিত। তাই ওর মায়ের সাপোর্টও অনেক বেশি পাবে। আর তার মনোজগত আমি যতটুকু গড়ে দিতে পেরেছি, আশা করি আর কোন অসুবিধা হবে না। এটুকু ভেবেই নিজেকে রিলাক্সড অবস্থায় নিয়ে যাই। মনে করি রবীন্দ্রনাথের কথা, সত্যেরে লও সহজে। নিশ্চিত মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হই। আর প্রস্তুত হতেই মনে পড়ে ‘এ হোল লাইফ’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত লাইন দুটি, ‘ডেথ ইজ দি কোল্ড লেডি... দি কোল্ড লেডি কামস এ্যান্ড টেকস এ্যান্ড গোস’- চোখ বুঝে মাথা হেলিয়ে দিয়ে সমস্ত শরীর দিয়ে অনুভব করি একজন কোল্ড লেডিকে। আর তার ভেতরই প্লেনটি ল্যান্ড করে। সত্যি স্যালুট করতে হয় আমাদের ক্যাপ্টেনকে। বাস্তবে এমন স্মুথ ল্যান্ডিং আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। না কোন আগুন নয়, কোন অসুবিধা নয়। প্লেনের ইঞ্জিন স্বাভাবিক সময়ের পর বন্ধ হয়। দিনের আলোয় যেমন আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় রাতের জোনাকিরা তেমনি মৃত্যুর আলোর সিগন্যাল নিয়ে আসা ফায়ার আর্মড কার ও এ্যাম্বুলেন্সগুলোও আস্তে আস্তে এয়ারপোর্ট থেকে মিলিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী আসাগাবাদ বিমানবন্দরে নামার প্রস্তুতি নেন, প্রধানমন্ত্রী ঘাড় ফিরিয়ে ফরেন সেক্রেটারিকে ডাকেন। কারণ, এখন তো সব কাজ ওই ভদ্রলোকের ঘাড়ে। যা হোক, আমরা আর প্লেন থেকে নামি না। বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা। বরং সবাই কোনভাবে নিজ নিজ স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কিনা সে চেষ্টাই করতে থাকি। যাক, সে গেল ভিন্ন বিষয়। ক্যাপ্টেন আমাদের জানান, বিমানে যে ত্রুটি দেখা দিয়েছে তা এক ঘণ্টার ভেতর ঠিক হয়ে যাবে। এর কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসেন সিকিউরিটি কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে কথা বলে দুটি তথ্য পাই, এক. তিনি বলেন, অনেক সময় কোন বড় ধরনের সঙ্কট হলে প্রধানমন্ত্রীর কপালে একটা ভাঁজ বা কপালে একটি কুঞ্চিত রেখা তাঁরা দেখতে পান। কিন্তু আজ তাঁরা তাও দেখেননি। তিনি একেবারে স্বাভাবিক ছিলেন। আর তিনি ককপিট থেকে ফিরে আসারও দশ থেকে বারো মিনিট পরে কেন ঘোষণা দিল তারও ইনডিরেক্ট উত্তর পাই ওই কর্মকর্তার কথার ভেতর দিয়ে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আসাগাবাদে নামার পনেরো মিনিট আগে ঘোষণা দিতে। কারণ বেশি আগে ঘোষণা দিলে যাত্রীদের ভেতর প্যানিক সৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে কলাবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে যখন শেখ হাসিনার ওপর তাঁকে হত্যার জন্য গুলি করা হয়, তখন কাছ থেকেই তাঁকে দেখেছি কোন ভয় তাঁর ভেতর কাজ করে না। শেখ হাসিনা যে বাংলাদেশে একমাত্র সাহসী ব্যক্তিত্ব এ কথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে একটা সত্য বলতে হয়, সাধারণত যে দুটোতে মানুষের সব থেকে বেশি ভয় দেখা যায়, এক. মৃত্যু ভয়, দুই. ক্ষমতা হারানোর ভয়। এই দুই ক্ষেত্রে তাকে কখনও ভীত হতে দেখিনি। তাঁকে হত্যা করার জন্য গুলি করার সময় থেকে শুরু করে আসাগাবাদ বিমানবন্দরের এই ঘটনা এমনি অনেক সময়ে তো তাঁর সঙ্গে থেকেছি। না কোন ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ঠিক তেমনি ক্ষমতা হারানোর ভয়ও নয়। জামায়াত-বিএনপি যখন অবরোধ দিয়ে প্রতিদিন পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে, সাতক্ষীরা, সাতকানিয়ায় যখন তারা এক ধরনের মুক্ত এলাকা তৈরি করতে চলেছে- এ সময়ে একেবারে ব্যক্তিগত আলোচনায় তিনি বলেছেন, দেখ, মানুষের জন্য রাজনীতি করি, মানুষের নিরাপত্তা দেয়া আমার কাজ- আমি সেটাই করব ও করছি। এরপরে আল্লাহ যদি আমায় ক্ষমতায় রাখেন আমি ক্ষমতায় থাকব- না রাখলে থাকব না। তাঁর মুখের সে দৃঢ়তা আমি শব্দ দিয়ে ছবি এঁকে দেখাতে পারব না। হয়ত সালভেদর দালি হলে মূর্তি গড়ে দেখাতে পারতেন তাঁর দৃঢ়তা। তবে মৃত্যুকে যে তিনি কোন গুরুত্বই দেন না তার প্রমাণ আমরা সবাই পাই আসাগাবাদ বিমানবন্দরের প্লেনে বসে। বাংলাদেশ টাইম ছ’টার পরে তিনি প্লেনে ফিরে আসেন। তাঁর উচ্ছল হাসিমাখা মুখ আমাদের কারও মনে যদি কোন বিন্দুমাত্র ভয় তখনও কাজ করছিল সেটাকে দূর করে দেয়। তিনি এসেই ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের জন্য নতুন বাজার ঠিক করে এলাম, তোমরা এখানে চামড়ার গার্মেন্টস এবং ওষুধ রফতানি করতে পারবে। পরে খোঁজ নিয়ে জানি, আসাগাবাদ বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা তুর্কমেনিস্তানের ডেপুটি স্পীকার ও অন্যদের সঙ্গে তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে তার ব্যবসা বাড়াতে পারে সে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর এই কাজ দেখে মনে হলো, শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে তাঁর ভাষণে তাঁর পিতা- জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অভিযোগ করেন, মানুষটি সারাজীবন দেশের কথা ভেবেছেন। সন্তান হিসেবে কখনও তাঁরা তাঁর কোন স্নেহ পাবার সুযোগ পায়নি। শেখ হাসিনা নিজেও কি তাঁর পিতার চরিত্রের বাইরে? তিনি তো মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গিয়ে আগেই ভাবছেন দেশের উন্নয়নের কথা। তুর্কমেনিস্তানে তাঁর এই ব্যবসা খোঁজার কাজটি সত্যি কী উপমা দিয়ে প্রকাশ করব তা আমার জানা নেই। যা হোক, হাঙ্গেরি বসে ও গত কয়েকদিনে বিমানের ওই দুর্ঘটনা সম্পর্কে এবং আমাদের বিমানযাত্রা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনেছি। তবে সেগুলো এখন লেখা উচিত নয়। কারণ একটি তদন্ত চলছে। পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবে কিছু তথ্য চিরকালের জন্য অপ্রকাশিত রেখে যেতে হয়। এ ধৈর্য না থাকলে তাঁর এ পেশায় আসা উচিত নয়। শেষ অবধি পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে মাইনাস ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আমরা হাঙ্গেরি পৌঁছি। তার পরের দুই দিনের প্রধানমন্ত্রীর কাজের খবর সব মিডিয়া প্রকাশ করেছে তা আর নতুন করে লেখার কোন যুক্তি নেই। তবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। যেমন হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় শেখ হাসিনা পৃথিবীকে একটি নতুন কথা শুনিয়েছেন। তা হলো, পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অর্থ বড় নয়, টেকনোলজি ও মেধা বিনিময়ই বড়। কারণ পৃথিবীর এখন প্রয়োজন সেই সক্ষমতা, যাতে প্রতিটি দেশ নিজ নিজ সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারে। হাঙ্গেরির সঙ্গে বাংলাদেশের সেই সম্পর্কই গড়তে চান প্রধানমন্ত্রী। আবার তাঁর কূটনীতির ভেতর কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই রাজনৈতিক কূটনীতির ছাপ স্পষ্ট। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন, তোমার দেশ তো আমার দেশ থেকে অনেক দূরে। শেখ হাসিনা তার উত্তরে বলেন, মনের দূরত্ব কেটে গেলে পথের দূরত্ব কোন বিষয় নয়। আমার দেশ আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য করছে না? হাঙ্গেরির এই সাধারণ একটি পানি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এত গুরুত্ব দিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রথমে আমার মনেও কিছুটা দ্বিধা ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন শুনি তাঁদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমরা ন্যাটোর সদস্য। এই একটি শব্দই কিন্তু আমার মনের দ্বিধা কাটিয়ে দেয়। কারণ, এর আগে একজন সাংবাদিক হিসেবে যে কাজ একটি দেশকে বোঝার জন্য করতে হয় সেগুলো আমি রাতদিন ঘুরে করেছি। আমি বুক সপে গিয়েছি, ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি, কিচেন মার্কেটে গিয়েছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি, কান্ট্রি সাইটে গিয়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি তাদের মানসিকতা ও অর্থনীতি। হাঙ্গেরিতে এখন মুদ্রাস্ফীতি বেশ বড় আকারে তা সবাই জানেন। কিন্তু তাদের তরুণদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে কথা বলে বুঝতে পারি, তারা আরও উন্নত জীবন খুঁজছে। তারা বুঝতে পারছে ইউরোপের ভেতর তারা সব থেকে দরিদ্র। কিন্তু তাদের এখন এক্সপ্লোর করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। তাদের কান্ট্রি সাইটে গেলে বোঝা যায়, তাদের আছে বিস্তীর্ণ ভূমি। অন্যদিকে বুক সপে গিয়ে কথা বলে জেনেছি, নতুন প্রজন্ম এখন খুব বেশি ইংরেজী শেখার দিকে ঝুঁকছে। যেমন পেস্ট শহরের বড় বুক সপ ‘বেস্ট সেলার’ ও ‘আলেকজান্দ্রা’। সেখানে গিয়ে হাঙ্গেরির সাহিত্য, রাজনীতি ও ইতিহাসের ওপর বেশ কিছু ইংরেজী অনুবাদের বই পাই। বই কেনার পরে উভয় বুক সপের মালিকের সঙ্গে কথা বলি, বেস্ট সেলার মালিক জিটা জানালেন, ১৯৯২ থেকে তিনি এই সপ চালু করেছেন, এখন ইংরেজী বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ইংরেজী শিখতে চায়। নতুন প্রজন্ম এই যে ইংরেজী শিখছে তার অর্থ এই সেন্ট্রাল ইউরোপকে তারা যোগ করতে চায় ভাষা দিয়ে মূল ইউরোপের সঙ্গে। ঠিক একই বিষয়ের প্রতিধ্বনি তাদের প্রধানমন্ত্রীর গলায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা ন্যাটো সদস্য। অর্থাৎ তিনিও তাঁর দেশকে নিয়ে যেতে চান মূল ইউরোপীয় দেশের কাতারে। অন্যদিকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ইউরোপের ভেতর আমরা সব থেকে দরিদ্র। অথচ আমাদের যথেষ্ট সম্পদ আছে। সম্পদ যে তাদের আছে তা কান্ট্রি সাইটে গেলে বোঝা যায়। এর থেকে সুস্পষ্ট সমীকরণে আসা যায়, হাঙ্গেরির ইকোনমি এখন এক্সপ্লোর করবে। তারা সে পথে হাঁটছে। বাংলাদেশের ইকোনমিও এখন এক্সপ্লোর করছে। তাই এ সময়ে সেন্ট্রাল ইউরোপের এই দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক, টেকনোলজিক্যাল ও মেধাভিত্তিক সম্পর্ক গড়া একান্তই প্রয়োজন। এখনই সময় তাদের উন্নয়নের সহযাত্রী হয়ে তার সুযোগ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে নেয়া। [email protected]
×