ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুমেল খান

টেনিসকন্যা জুঁই-লিয়ার কথকতা...

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

টেনিসকন্যা জুঁই-লিয়ার কথকতা...

দুজনেই পড়ে ভিকারুননিসা নুন স্কুলে, অষ্টম শ্রেণীতে। দুজনেই খেলে এলিট টেনিস একাডেমির হয়ে (মজা করে এজন্য অনেকেই তাদের ‘এলিট টেনিসকন্যা’ বলে ডাকে!)। দুজনেই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। দুজনেরই প্রিয় খেলোয়াড় ফেদেরার এবং শারাপোভা। দুজনেই চায় খেলা ছাড়ার পরও টেনিসের সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকতে। রমনার জাতীয় টেনিস এশিয়ান অনুর্ধ-১৪ সিরিজ টেনিস প্রতিযোগিতার সমাপনী দিনে দেখা হয় ওই দুই টেনিসকন্যার সঙ্গে। এদের একজন সুমাইয়া হোসেন লিয়া। অন্যজন শ্রাবণী বিশ্বাস জুঁই। জুঁইয়ের পায়ে আবার ব্যান্ডেজ। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লিয়ার এই সমস্যা নেই। কাজেই সে টেনিস কমপ্লেক্সজুড়ে চপলা হরিণীর মতো দৌড়াচ্ছিল। কথাবার্তায় দুজনেই সাবলীল। টেনিস নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনাও করে বলে মনে হলো। লিয়ার জন্ম ৯ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালে। ২০১৫ সাল থেকে এলিট টেনিস একাডেমিতে খেলছে সে। তার আগে ২০১১-১৩ পর্যন্ত খেলেছে স্কুল এবং আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্টগুলোতে। ২০১১ সালে স্কুলে টিম ইভেন্টে রানার্সআপ, ২০১৩ সালে দ্বৈতে রানার্সআপ হয়। লিয়ার চেয়ে বয়সে মাস ছয়েকের ছোট জুঁই (জন্ম : ২০ জুন, ২০০৪)। এলিট টেনিস একাডেমিতে যোগ দেয়ার আগে সেও চার বছর ধরে খেলেছে ভিকারুননিসার হয়ে। যদিও শুরুটা করে আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতা দিয়ে। প্রতি বছরই আন্তঃস্কুল পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় একক এবং দ্বৈতে। এত খেলা থাকতে টেনিসকে বেছে নেয়া কেন? লিয়ার জবাব, ‘টিভিতে বিশ^ টেনিসের খেলা দেখে ছোটবেলা থেকেই খেলাটির প্রতি আকর্ষণবোধ করতাম। এছাড়া শাহবাগ হয়ে যখন মানিকগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে যেতাম, তখন বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়তো। ফলে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।’ লিয়া-জুঁই দুজনেই হচ্ছে টেনিস ফেডারেশনের প্রতিভা অন্বেষণের ফল। এ প্রসঙ্গে লিয়ার স্মৃতিচারণ, ‘আমাদের স্কুলে টেনিসের ওপর একটি ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম হয়। তখন সেখানে টেনিস ফেডারেশনের পক্ষ থেকে গিয়েছিলেন মাহমুদ আলম স্যার। উনি একটি ট্রায়ালের আয়োজন করেন। ছয় দিনব্যাপী ট্রায়ালে সেখানে অন্যদের সঙ্গে আমিও অংশ নিই। আমার খেলা দেখে মাহমুদ স্যার আমাকে বাছাই করেন (আমিসহ মোট ৩০ জন)। এভাবেই জড়িয়ে যাই টেনিসে। সেটা ২০১১ সালের কথা। তখন আমি পড়ি ক্লাস থ্রিতে।’ জুঁইয়ের মন্তব্য, ‘আমাদের স্কুলে টেনিস ফেডারেশনের ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে আমি নির্বাচিত হই। যদিও আমি শুরু করি এক বছর পর। পরে এলিট টেনিস একাডেমিতে যোগ দেই সাজ্জাদ স্যার ও দীপক স্যারের মাধ্যমে।’ টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে নিজেদের বর্তমান অবস্থানটা কোথায়? কোন জায়গায় ঘাটতি বা দুর্বলতা আছে? ‘বাংলাদেশে টেনিসে ছেলেরা যতটা উন্নতি করছে, মেয়েরা ততটা নয়। আমাদের আরও প্রশিক্ষণ, অনুশীলন এবং ফেডারেশন থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া দরকার। নইলে বাইরের দেশের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে দাঁড়াতেই পারব না। এখন হয়ত খেলতে গেলে ৩-৪ গেম পর্যন্ত পাওয়া যায়, কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। শেখার তো আসলে কোন শেষ নেই। আমাদের যত শেখাবে, ততই আমাদের খেলায় উন্নতি হবে।’ লিয়ার অভিমত। লিয়ার প্রিয় টেনিস খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্রের সেরেনা উইলিয়ামস। ড্রাগের ব্যাপারটা বাদ দিলে রাশিয়ার মারিয়া শারাপোভার সবকিছুই ভাল লাগে তার। আর পুরুষদের মধ্যে প্রিয় সুইজারল্যান্ডের রজার ফেদেরার। জুঁইয়েরটা? ‘আমার টেনিস আইডল সুইজারল্যান্ডের রজার ফেদেরার এবং রাশিয়ার মারিয়া শারাপোভা।’ টেনিস ছাড়া উভয়েরই অন্য প্রিয় খেলা ফুটবল। তবে প্রিয় ফুটবলার হিসেবে এক্ষেত্রে আবার দুজনের পছন্দের ভিন্নতা আছে। লিয়ার মনপ্রাণ জুড়ে আছে আর্জেন্টিনা এবং বার্সেলোনার লিওনেল মেসি। আর জুঁইয়ের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছে জার্মানি এবং বায়ার্ন মিউনিখের টমাস মুলার। টেনিস ফেডারেশন থেকে কতটা সুযোগ-সুবিধা পাও বা বা কতটা দরকার? এমন প্রশ্নে লিয়ার সপ্রতিভ জবাব, ‘অবশ্যই ফেডারেশনের আমাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো উচিত। রমনা টেনিস কমপ্লেক্সে যদি ফ্লাডলাইট থাকত তাহলে রাতে এসেও আমরা অনুশীলন করতে পারতাম।’ একসময় টেনিস খেলার পাশাপাশি লিয়া ক্রিকেটও খেলত। মজার ব্যাপারÑ তার বাবাও তার সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন! এ প্রসঙ্গে লিয়ার বক্তব্য, ‘ক্রিকেট খেলাটা বেশি আলসেমির খেলা মনে হয়, টেনিসে আছে পরিশ্রম আর প্রতি মুহূর্তে লড়াইয়ের রোমাঞ্চ, তাই পরে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিই। যদিও জানি, বাংলাদেশে টেনিস খেলে অর্থ উপার্জন করা যায় না ক্রিকেটের মতো। তবে এটা বিশ^াস করি একসময় যেমন দেশের এক নম্বর খেলা ছিল ফুটবল, এখন যেমন এক নম্বর খেলা ক্রিকেট, তেমনি আগামীতেও এক নম্বর খেলা হবে টেনিস। আমি সেই সময়ের একজন যোদ্ধা হয়ে থাকতে চাই।’ আজ থেকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চাও? জুঁই যেন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে নিজের লক্ষ্যটা, ‘এবার না পারলেও পরের এশিয়ান অনুর্ধ-১৪ টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। এই আসরে অংশ নেয়ার মতো বয়স (আরও দুই বছর) এখনও আমার আছে। এরপরের লক্ষ্য অনুর্ধ-১৮ আসর।’ একই আকাক্সক্ষা লিয়ারও, ‘এশিয়ান অনুর্ধ-১৪ আসরে আগামী বছরও খেলতে পারবো। চেষ্টা করব কোয়ার্টার বা সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠতে। আর ফাইনালে উঠতে পারলে তো কথাই নেই।’ খেলার সুবাদে দু’বার থাইল্যান্ডে গেছে জুঁই। একবার ২০১৪ সালে অনুর্ধ-১৪ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ নিতে, আরেকবার ২০১৬ সালে ডিভিশন-২ টুর্নামেন্টে খেলতে। এলিট টেনিস একাডেমির হয়ে খেলে কোন পারিশ্রমিক না পেলেও এখানে ফ্রি কোচিং পায় জুঁই-লিয়ারা। ‘এটাই আমাদের জন্য অনেক কিছু। কেননা এখানে কোচিংয়ের মান অনেক ভাল।’ জুঁইয়ের ভাষ্য। ক্যারিয়ারের স্মরণীয় ম্যাচ? জুঁইয়ের কথা, ‘এবারের এই আসরেই একটা এককের ম্যাচ জিতি (কনসুলেশন ম্যাচ) এ্যাঙ্কেলের ইনজুরি নিয়েও। প্রতিপক্ষ ছিল ঝালকাঠির ঐশী। খেলার আগে থেকেই ব্যথা ছিল। সেটা প্রথম ম্যাচেই পাই। ঐশীর সঙ্গে ছিল পঞ্চম ম্যাচ। কষ্ট করে খেলে প্রথম গেমে টাইব্রেক পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে সেটা জিতি (৭-৪)। দ্বিতীয় সেটে অবশ্য সহজেই জিতি (৬-১)। এছাড়া ২০১৫ সালে আরেকটা স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছিলাম, সাভারের জিরানির বিকেএসপিতে। জাতীয় টুর্নামেন্ট ছিল ওটা। লামিসা ফাবিহা সূচনার সঙ্গে জুটি বেঁধে দ্বৈতে প্রতিপক্ষ বিকেএসপির জলি তৃপ্তি এবং তার পার্টনারের সঙ্গে (নামটা ঠিক মনে নেই) খেলছিলাম। ওই ম্যাচে আমরা ২-৫ গেমে পিছিয়ে থেকেও ওভারকাম করে ৭-৫ গেমে জিতে যাই। খেলাতেও জিতেছিলাম।’ টেনিস খেলতে গিয়ে কোন বাধার সম্মুখীন হওয়া প্রসঙ্গে জুঁই বলে, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমার বাবা ড. বিপুল কান্তি বিশ^াস (হার্ট স্পেশালিস্ট) টেনিস খেলাটা ঠিক পছন্দ করেন না। তবে মা ইনকাম ট্যাক্স অফিসার (ইন্সপেক্টর) শংকরী মিশ্রি আমাকে পূর্ণ সমর্থন দেন। তাই বলে বাবা খেলতে বাধা দেননি কখনও। এটাও আমার জন্য অনেক বড় ও ইতিবাচক ব্যাপার।’ আর লিয়ার কোন সমস্যাই নেই, ‘বাবা লিয়াকত হোসেন সিটি কর্পোরেশনে কাজ করেন। মা লিপি সুলতানা গৃহবধূ। আমার বাবা-মা দুজনেই আমাকে টেনিস খেলতে উৎসাহিত করেছেন। এক্ষেত্রে বরং বাবা একটু বেশিই।’ টেনিস নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কার কেমন? জুঁইয়ের লক্ষ্য চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়া। এর পাশাপাশি টেনিসটাও সিরিয়াসলি এবং সময় পেলে খেলতে চায়। ভবিষ্যতে এই খেলা থেকে অবসর নিলেও তখনকার ভবিষ্যত প্রজন্মকে টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করতে আগ্রহী সে। লিয়ার সবসময়ের ইচ্ছা, ‘যেটা আমার প্যাশন, সেটাই আমার প্রফেশন হবে। যে কাজটা করতে ভাল লাগে, সেটাকে পেশা হিসেবে নিলে কখনই তা বিরক্তিকর বা একঘেয়ে মনে হবে না। টেনিস নিয়ে এমনটাই পরিকল্পনা আছে। আগামীতে টেনিস কোচ হতে চাই।’ টেনিসকন্যা জুঁই এবং লিয়ার এই সুনীল স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিক, এটাই ক্রীড়াপ্রেমীদের নিগুঢ় প্রত্যাশা।
×