ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

দুই অধিনায়কের তিক্ত অভিজ্ঞতা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

দুই অধিনায়কের তিক্ত অভিজ্ঞতা

দু’জন দারুণ সফল জাতীয় দলের হয়ে। গত দুই বছরে দুই অধিনায়কের অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল একের পর এক স্বর্ণালী সাফল্য পেয়েছে। আর তাদের নেতৃত্বাধীন দলটিই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্যগুলো এনে দিয়ে এখন সর্বসেরা। মাশরাফি বিন মর্তুজার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ দল ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটে শক্তিধর ও ভয়ঙ্কর একটি দলে পরিণত হয়েছে। আর মুশফিকুর রহীম টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে গুছিয়ে তুলেছেন। সাফল্যও ধরা দিতে শুরু করেছে মর্যাদার এ ফরমেটে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সাফল্য পাওয়া এই দুই অধিনায়কের জন্যই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে এবার দেশের জনপ্রিয় ক্রিকেট আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০। কারণ পয়েন্ট টেবিলে সবার তলানিতে থেকে শেষ হয়েছে তাদের নেতৃত্বাধীন দল। মাশরাফির নেতৃত্বে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ১২ ম্যাচে ৫ জয়ে ১০ পয়েন্ট নিয়ে ৬ নম্বরে থেকে লীগ পর্ব শেষ করে। আর মুশফিকুর রহীমের দল বরিশাল বুলস ৭ দলের এ আসরে ১২ ম্যাচে মাত্র ৪ জয়ে ৮ পয়েন্ট নিয়ে সবার নিচে থেকে শেষ করেছে। দু’দলই গত আসরে ফাইনাল খেলেছিল। এবার তাদের ভরাডুবি হয়েছে জাতীয় দলের দুই সফলতম অধিনায়কের অধীনে থেকেই। বিষাদময় তিক্ত অভিজ্ঞতাটা সঙ্গী হয়েছে মাশরাফি আর মুশফিকের। গত বিপিএলের নবাগত দল ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। দল গঠনের দিক থেকেও তেমন আহামরি কোন ক্রিকেটারকে নিয়ে ব্যালান্সড দল গড়তে পারেনি তারা। কিন্তু সেই দলটিকে দারুণ নেতৃত্ব দিলেন মাশরাফি। নিজে ব্যাটে-বলে যেমন দুরন্ত ছিলেন, তেমনি দলকে সংঘবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রেও তার যোগ্য নেতৃত্ব কুমিল্লাকে করেছিল একতাবদ্ধ। ফলশ্রুতিতে প্রথম আসরেই সবাইকে চমকে দিয়ে বাজিমাত করে কুমিল্লা, শিরোপা জয় করে তারা। কিন্তু এবার মাশরাফি সেই ম্যাজিকটা দেখাতে পারেননি। বিপিএলের শুরু থেকেই পরাজয়ের বৃত্তে বন্দী হয়ে যায় কুমিল্লা। অধিনায়ক মাশরাফিকেও যেন মাঠে সেভাবে চেনা যাচ্ছিল না। টানা ৫ ম্যাচে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্টের শুরুতেই ছিটকে পড়ার শঙ্কা ঘনীভূত হয়। অথচ মাশরাফির নেতৃত্বে এই বিপিএলের আগেই বাংলাদেশ জাতীয় দল ঘরের মাটিতে টানা ৬ সিরিজ জয় করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বে। কারণ পরাজিত দলের তালিকায় দুইবার জিম্বাবুইয়ে ছাড়াও ছিল পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো তিনটি ক্রিকেট পরাশক্তি। এরপর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেও এ বছর খেলা প্রথম ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে জয় পায়। তবে টানা জয়ের ছন্দপতন ঘটে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরে। তবে সেই সিরিজেও দুর্দান্ত খেলে বিশ্ব ক্রিকেটকে বাংলাদেশ দল জানিয়ে দেয় অপ্রতিরোধ্য এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে তারা। এছাড়া ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার যোগ্যতাও অর্জন করে বাংলাদেশ। মাশরাফির নেতৃত্ব দুরন্ত হয়ে ওঠা বাংলাদেশ দল আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে ইতিহাসে নিজেদের সেরা অবস্থান সাত নম্বরে উঠে আসে। সেই মাশরাফি এবার পারেননি কুমিল্লাকে ঠিকমতো গোছাতে। এর পেছনে ছিল মালিকপক্ষের সঙ্গে মতানৈক্য। এ কারণে টুর্নামেন্টের মাঝপথে টিম হোটেল ছেড়ে নিজ বাসায় চলে আসেন তিনি। কারণ অধিনায়ক মাশরাফি মনমতো একাদশ নিয়ে মাঠে নামতে পারছিলেন না, এ কারণেই বারবার তিনি হারের পর সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন, ‘এখনও আমরা সঠিক সমন্বয় খুঁজে পাইনি।’ শেষটা ভাল হয়েছে কুমিল্লার। টানা ৪ ম্যাচ জিতে মোটামুটি মর্যাদা নিয়েই শেষ করতে পেরেছেন মাশরাফি। বল হাতে শুরুর দিকে নিষ্প্রভ থাকলেও পরের দিকে জ্বলে উঠেছেন। নেতৃত্বেও দেখা গেছে চিরাচরিত চেহারার মাশরাফিকে। কিন্তু শেষ চারে ওঠা হয়নি। অথচ আগের তিন আসরেই তিনি ছিলেন চ্যাম্পিয়ন, প্রথম দুই আসরে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সকে শিরোপা জিতিয়েছেন এবং গত আসরে কুমিল্লাকে। এবারের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তাই খুব বেশি হতাশা নেই মাশরাফির। তিনি বলেন, ‘এবার দেখে শান্তি পাব। শেষ তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। অবশ্যই ভাল লেগেছে। এবার আমাদেরই সতীর্থ কেউ হবে। এখানে আফসোসের কিছু নেই। এ ধরনের টুর্নামেন্টে এমনই হয়। আর অবশ্যই উপভোগ করব। গত আসরের মতো সবসময় হবে না। আমরা টর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছি। তবে ভাল লাগছে যে আমরা অন্তত শেষ দিকে এসে জয়ের ধারায় ফিরতে পেরেছি। শুরু থেকে আমরা টুর্নামেন্টে কোথাও ছিলাম না। আমরা পাঁচ-ছয়টা ম্যাচ পর্যন্ত সবার নিচে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ছয়ে শেষ করলেও ১০টা পয়েন্ট নিয়ে শেষ করতে পেরেছি। আমি মনে করি, খেলোয়াড়দের সবারই খুব ভাল লাগছে।’ কুমিল্লার শেষদিকের দুর্দান্ত নৈপুণ্য আশা জাগিয়ে তুলেছিল শেষ চারে ওঠার। কিন্তু মুশফিকের নেতৃত্বাধীন বরিশাল বুলসের বাজে নৈপুণ্য সেটা হতে দেয়নি। নিজেদের শেষ গ্রুপ ম্যাচে রংপুরের কাছে হেরে বরিশাল বিদায় নিয়েছে, সঙ্গে কুমিল্লাও ছিটকে গেছে। মুশফিকের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য প্রতিটি বিপিএল আসরে দারুণ হলেও তিনি কোন আসরেই কোন দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হতে পারেননি। বিপিএলের ইতিহাসে সর্বাধিক ১১৭২ রানের মালিক তিনি। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিপিএলে ১ হাজার রানও পূর্ণ করেছেন এবারের আসরে। ২০১৩ সালের দ্বিতীয় আসরে ৪৪০ রান করে সবার ওপরে ছিলেন। এ বছরও তিনি ১২ ম্যাচে ৩৪১ রান করে চার নম্বরে থেকে শেষ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে উজ্জ্বল মুশফিক কোন আসরেই তার দলকে উজ্জ্বলতর হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেননি। গত আসরে তার নেতৃত্বে সিলেট সুপারস্টারস সবার তলানিতে থেকে শেষ করেছিল। আর প্রথম দুই আসরে অবশ্য দুরন্ত রাজশাহী ও সিলেট রয়্যালসকে শেষ চারে তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেখানেই অভিযান শেষ হয়েছিল। এবার তো আরও বাজেভাবে সবার নিচে থেকে শেষ করল তার নতুন ঠিকানা বরিশাল। অথচ গত আসরের রানার্সআপ ছিল দলটি। এ বিষয়ে মুশফিক বলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে আমাদের শুরুটা ভাল হলেও শেষে গিয়ে আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। আশা করি পরের আসরে ভালভাবে ফিরতে পারব। আমরা প্রথম ম্যাচটি হারার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর টানা তিনটি ম্যাচ জিতেছিলাম। কিন্তু এরপর আমরা সেই ধারা ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের মূল খেলোয়াড় মালান ইনজুরিতে পড়ল। পাশাপাশি আমাদের টপ অর্ডাররাও ভাল করতে পারেনি। সব মিলিয়ে আমরা পারফর্মেন্স ভাল করতে পারিনি।’ টানা হারের বৃত্তে পড়ে যাওয়া দলটি ম্যাচ গড়াপেটা করছে এমন অভিযোগও করেছিলেন দলের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। তবে সেসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান মুশফিক। জাতীয় দলের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে গত দুই বছর ধরেই বেশ সফল তিনি। তার নেতৃত্বে সর্বশেষ ১০ টেস্ট খেলা বাংলাদেশ দল জিতেছে ৪টি, হেরেছে মাত্র ২টি এবং ড্র করেছে বাকি ৪টি। একটি সিরিজ জিতেছে, তিনটি ড্র করেছে এবং একটি হেরেছে বাংলাদেশ দল। সর্বশেষ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুই টেস্টের সিরিজে একটি জিতে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছে টাইগাররা। টানা তিন টেস্ট সিরিজে মহাপরাক্রমশালী ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করেছে দল। মুশফিকের নেতৃত্বে যেন টেস্ট ক্রিকেটেও ক্রমে শক্তিধর দলে পরিণত হতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। সেই মুশফিকের বিপিএল অভিজ্ঞতাটা আবারও তিক্ততায় ছেয়ে গেছে। জাতীয় দলের দুই যোগ্যতম ও সফলতম কান্ডারী বিফলতার হতাশা নিয়ে শেষ করেছেন বিপিএল।
×