ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদ

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের একটা অঙ্গীকার ছিল আমেরিকাকে আবার মহান রাষ্ট্রে পরিণত করা- ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন!’ এই সেøাগান বা অঙ্গীকারের দ্বারা তিনি ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রিগ্যানের নির্বাচনী প্রচারকে প্রতিধ্বনিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট কার্টারের প্রশাসনের একের পর এক ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ১৯৮০ সালে মার্কিন ভোটাররা একটা পরিবর্তন চাইছিল। আমেরিকার ভূলুণ্ঠিত গৌরবকে আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছিল। তাই তারা রিগ্যানকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে ছিল। এবার তারা ট্রাম্পকে জয়যুক্ত করেছে। কারণ তিনি তাদের এমন এক পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছেন যা ঐতিহাসিক এবং জীবদ্দশায় একবারই। তবে রিগ্যানের সময় ও ট্রাম্পের সময়ের মধ্যে এক বিশাল পার্থক্য আছে। রিগ্যান বিশ্বকে নিরাপদ রাখতে আমেরিকা যা কিছু অবদান রাখতে পারে তার একটা তালিকা তুলে ধরে তিনি এমন এক দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যা অন্তর্মুখী হবে না, হবে বহির্মুখী- অর্থাৎ অন্যদের দিকে দৃষ্টি দেবে। অর্থাৎ রিগ্যানের আমেরিকা ছিল বিশ্বায়নের পক্ষে। অন্যদিকে ট্রাম্প আমেরিকাকে সব বিষয়ে সবার আগে স্থান দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি আমেরিকা ও এর জনগণকে আর বিশ্বায়নের মিথ্যা সেøাগানের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। বিশ্বায়নের ব্যাপারে রিগ্যান ছিলেন আশাবাদী আর ট্রাম্প হচ্ছেন ক্রুদ্ধু। অর্থাৎ ট্রাম্পের সময় নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই প্রথম বৃহৎ ও উদীয়মান শক্তিগুলো যুগপৎ বিভিন্ন ধরনের জাত্যভিমানের দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ট্রাম্পের মতো রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের নেতারাও এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন সেখানে বৈশ্বিক স্বার্থের সঙ্গে তাদের জাতীয় স্বার্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ এক বিরাট পরিবর্তন যা এক অনাগত বিপজ্জনক বিশ্বের অশনি সঙ্কেত বহন করে। জাতীয়তাবাদ এক পিচ্ছিল ধারণা। বিকাশের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় জাতীয়তাবাদ অভিন্ন কিছু মূল্যবোধের চারপাশে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে এমন কিছু অর্জন করেছে যা দেশের জনগণ এককভাবে কিছুতেই অর্জন করতে পারত না। এটা হলো নাগরিক জাতীয়তাবাদ। এ জাতীয়তাবাদ সমঝোতাকামী ও প্রগতিমুখী। এই জাতীয়তাবাদের কিছু সর্বজনীন মূল্যবোধ আছে যেমন স্বাধীনতা ও সাম্য। এই জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আছে জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী ও অতীত স্মৃতিকাতর এবং দেশকে আলাদাভাবে তুলে ধরার জন্য জাতি বা ইতিহাসকে আশ্রয় করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্ধকারতম অধ্যায়ে জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্পের রাজনীতি নাগরিক জাতীয়তাবাদের ওপর আঘাত। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন নেতাদের দেশপ্রেম নিয়ে কারোর কোন সন্দেহ করার কারণ ঘটেনি। অথচ তারা সবাই আমেরিকার সর্বজনীন মূল্যবোধের পক্ষে ছিলেন এবং সেই মূল্যবোধ বাইরেও প্রসারিত করেছিলেন। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন দিয়ে এই নেতারা যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বকে অধিকতর নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প এসব মূল্যবোধকে দুর্বল করে দেয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাশিয়ায় ভøাদিমির পুতিন কসমোপলিটান উদার মূল্যবোধ বর্জন করে সøাভিক ঐতিহ্য ও অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মমতের মিশ্রণ স্বতন্ত্র রুশ জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা করে তুলেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বে ইসলামী জাতীয়তাবাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আধুনিকমনস্ক হলেও উগ্রজাতীয়তাবাদ ও অসহিষ্ণুতার প্রচারক র‌্যাডিকেল জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী হিন্দু সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ। এদিকে চীনা জাতীয়তাবাদ এত উগ্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে যে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। চীনের জনগোষ্ঠীকে সিংহভাগ হান জাতিভুক্ত। সর্বত্র এই হানদেরই প্রাধান্য ও দাপট। হান বাদে আর সবাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে পরিগণিত। ওদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারণা করেছিল যে উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে সেটি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এর অপমৃত্যু হবে। আর এই সংগঠনের মধ্য দিয়ে ক্যাথলিক, ফরাসী, ইউরোপীয় ইত্যাদি ভেদাভেদ ও জাতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা মুছে যাবে। অথচ ইউরোপের বৃহত্তর অংশে তা কখনই ঘটেনি। ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে। পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরীতে ক্ষমতা উগ্র জাতীয়তাবাদের হাতে চলে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ফ্রান্স ও ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে এবং এভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সংস্থাটি। যুক্তরাষ্ট্র শেষবারের মতো অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছিল প্রথম মহাযুদ্ধের পর। এর পরিণতি হয়েছিল বিপর্যয়কর। ট্রাম্পের নয়া জাতীয়তাবাদও তেমনি বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বদেশে অসহিংসতার জন্ম দেবে এবং সংখ্যালঘুর গুণাবলী ও আনুগত্য নিয়ে সংশয়-সন্দেহ জাগ্রত হবে। ইতোমধ্যে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মার্কিন রাজনীতিতে এন্টি-সেমিটিজম সংক্রমিত হয়েছে। এ কারণে ছোট দেশগুলোর জন্য ভবিষ্যত কঠিনতর হয়ে দাঁড়াবে। আগামী দিনের বিশ্বে অস্থিরতা নতুন মাত্রা লাভ করবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×