ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ শতাংশের বেশি অবৈধ ফোনের দখলে

মোবাইল ফোনের বাজার সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

মোবাইল ফোনের বাজার সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশে মোবাইল ফোনের বাজারের আকার মোট সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার। এরমধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি অবৈধভাবে আসা মোবাইল ফোনের দখলে। অবৈধভাবে আসা এসব মোবাইল ফোন তৈরি করেছে ‘গ্রে মার্কেট’। এ মার্কেটের আকারও প্রায় দুই হাজার কোটি (১ হাজার ৮৭৫ কোটি) টাকার মতো। আর এ বাজারের কারণে সরকার প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। মোবাইল ফোন আমদানিকারক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ)-এর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দেশের বৈধ মোবাইল ফোনের বাজারের ওপর হুমকি হয়ে উঠছে এই গ্রে মার্কেট বা অবৈধ বাজার। দিন দিন এ বাজারের আকারও বাড়ছে। গত দুই-তিন বছর ধরে এর হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এবছর এখনও পর্যন্ত দেশে এসেছে প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ পিস মোবাইল ফোন সেট। এর মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি এসেছে অবৈধ পথে। বিএমপিআইএ সূত্র বলছে, অবৈধ পথে দেশে আসে বেশিরভাগই নামীদামী ব্র্যান্ডের ফোন। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আই ফোন। এরপরে রয়েছে স্যামসাং, এইচটিসি এবং হালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ব্র্যান্ড শাওমি। জানা গেছে, একটি মোবাইল ফোনসেট আমদানি করতে শুল্ক বাবদ (মোবাইলের দামের ওপর) আমদানিকারকদের পরিশোধ করতে হয় ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ টাকা। আগের তুলনায় মোবাইল সেটের ওপর শুল্কসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায়, অবৈধ পথে মোবাইল ফোনের প্রবেশও বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) ডাটাবেজের অভাব এবং তা পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, শুল্ক জটিলতায় দেশে মোবাইল উৎপাদন না হওয়া, দেশে নকল আইএমইআই সুলভ হওয়া, গ্রে মার্কেটের দোকান বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ রয়েছে অবৈধভাবে দেশে মোবাইল প্রবেশের মূলে। এসব বন্ধ করা গেলে দেশে অবৈধ পথে মোবাইল ফোন প্রবেশ কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বিএমপিআইএ-এর সভাপতি রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, ‘অবৈধ পথে আসা মোবাইল ফোনের কারণে আমাদের সংগঠনের সদস্যরা বাজার হারাচ্ছে। গ্রে মার্কেটের মোবাইল অনেক কম দামে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে পারছেন। ওদের দামের কাছে আমরা টিকতে পারছি না। ফলে আমরা বাজার হারাচ্ছি, আর ওদের বাজার বড় হচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘ওরা আমাদের মতো ওয়ারেন্টি ও সার্ভিস ওয়ারেন্টি না দিয়ে, মোবাইল কম দাম দিয়ে শুধু সার্ভিস ওয়ারেন্টি অফার করছে। ফলে ক্রেতারা ওদের দিকে ঝুঁকছে।’ তিনি বলেন, ‘আইএমইআই ডাটাবেজ তৈরি, নিবন্ধনের ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের কড়া নজরদারি থাকলে দেশে অবৈধ পথে মোবাইল ফোনের প্রবেশ বন্ধ হবে।’ স্যামসাং মোবাইল ফোনের ৩০ ভাগ মোবাইল গ্রে মার্কেটের দখলে উল্লেখ করে মাহবুব বলেন, ‘আমরা বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকা হারাচ্ছি।’ স্যামসাংয়ের বাজার আকার বছরে ২০০ কোটি টাকা মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অবৈধ পথে মোবাইল ফোনসেট আসা বন্ধ না হলে মূল বাজার আর বড় হবে না। সবচেয়ে দামি মোবাইল আই ফোনের ৯০ শতাংশ দেশে আসে অবৈধ পথে। হাতে হাতে, লাগেজে বা যন্ত্রাংশ আকারে দেশে ঢুকছে আই ফোন।’ এছাড়া শাওমি, এইচটিসি মোবাইলও অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে বলে তিনি জানান। বিএমপিআইএ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রতিবছর স্মার্টফোনের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৫ সালে দেশে মোট ২ কোটি ৬০ লাখ মোবাইল ফোন সেট আমদানি হয়। এর ২৩ ভাগ (৬০ লাখ) হলো স্মার্টফোন। ২০১৩ সালে যার পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ, ২০১৪ সালে ৪০ লাখ, ২০১৫ সালে ৬০ লাখ স্মার্টফোন দেশে আমদানি হয়। চলতি বছরের শেষনাগাদ হতে পারে ৯০ লাখ। চলতি বছর শেষে মোট মোবাইল ফোনসেট আমদানির পরিমাণ হতে পারে ৩ কোটি। অন্য এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর স্মার্টফোনের প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ। সিম্ফনি মোবাইলের জ্যেষ্ঠ পরিচালক রেজওয়ানুল হক বলেন, ‘মোবাইল সেটের আমদানি শুল্ক কমানো গেলে গ্রে মার্কেটের সঙ্গে বৈধ পথে আসা মোবাইলের দামে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। ফলে গ্রে মার্কেটে আসা মোবাইলের সংখ্যা কমবে।’ তিনিও উল্লেখ করেন, ‘গত দুই তিন বছর দেশে মোবাইল ফোনের আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় গ্রে মার্কেটও বড় হচ্ছে।’ শাওমি মোবাইল ফোনের বাংলাদেশে অনুমোদিত পরিবেশক এসইবিএল (সোলার ইলেক্ট্রো বাংলাদেশ লিমিটেড) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান কানন বলেন, ‘শাওমি অল্প দিনে জনপ্রিয়তা লাভ করায় অবৈধ পথে বেশি আসছে। শতকরা হিসেবে প্রায় ৪০ শতাংশ, ক্ষেত্র বিশেষে তা ৫০ শতাংশেরও বেশি। এতে করে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে। তেমন আমরাও বাজার হারাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশে আইএমইআই-এর ডাটাবেজ করা সম্ভব হলে অবৈধ পথে আসা মোবাইল ফোনের সংখ্যা কমবে। আইএমইআই ডাটাবেজ তৈরি হলে আমাদের আমদানি করা মোবাইলের আইএমইআই অগে থেকেই ডাটাবেজে থাকবে। আমদানির পরে দেশে মোবাইল ঢুকতে গেলে শুরুতেই চেক করে ঢুকবে। অন্যদিকে অবৈধ পথে আসা মোবাইল চালু করতে গেলে যদি ‘আইএমইআই বারিং’ চালু থাকে, তাহলে বার বসে যাবে। ফোন চালু হবে না। তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে আইএমইআ-ই নিবন্ধন করে নিতে হবে।’ দেওয়ান কানন মনে করেন, ‘এভাবে দেশে আসা অবৈধ মোবাইল ফোনের প্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে অবৈধ মোবাইল ফোন সেট শনাক্ত করতে একটি শক্তিশালী আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ) বেসরকারীভাবে এই ডাটাবেজ তৈরি করছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ডাটাবেজের সফটওয়্যারের উদ্বোধন করার কথা থাকলেও এর কাজ শেষ না হওয়ায় তা উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি। সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, সফটওয়্যার অংশের কাজ শেষ। হার্ডওয়্যারের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। শীঘ্রই তা শেষ হবে। চলতি বছরের মধ্যেই ডাটাবেজ চালু করা যাবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জানা গেছে, ডাটাবেজ তৈরি হলে কোন মোবাইল সেট চালু করতে গেলে তার আইএমইআই নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপারেটরদের ডাটাবেজে চলে যাবে। ফলে ওই নম্বরটি সংরক্ষিত থাকবে।
×