ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরেক শিক্ষার্থী নিখোঁজ ॥ মাঠে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

আরেক শিক্ষার্থী নিখোঁজ ॥ মাঠে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা

শংকর কুমার দে ॥ রহস্যজনকভাবে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে পাঁচ দিন আগে চার শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার পর সোমবার সাঈদ আনোয়ার (১৮) নামে আরও এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। নিখোঁজ পাঁচ শিক্ষার্থীর সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর জঙ্গী অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সারাদেশে নিখোঁজদের তালিকা তৈরি করে গত ২০ জুলাইয়ে ২৬২ জন নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। তালিকাটিতে থাকা নিখোঁজ ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক কলহ, বিভিন্ন কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মুখে আবার ফিরে আসতে শুরু করে। তালিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে মাত্র ছয় দিনের মাথায় গত ২৫ জুলাই র‌্যাব নিখোঁজ তালিকাটি সংশোধন করে ২৬২ জনের পরিবর্তে মাত্র ৬৮ জনের নিখোঁজ তালিকা প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ২৬২ জনের মধ্যে ১৯৪ জন নিখোঁজই ফিরে এসেছে, নয়তো সন্ধান মিলেছে, এমনকি থানায় এসেও হাজির হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর দেখা গেছে, বিত্তবান ঘরের উচ্চ শিক্ষিত সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, আইটি বিশেষজ্ঞ নিখোঁজ হওয়ার তালিকায় রয়েছে। এদের অনেকেই জঙ্গী সংগঠনগুলোতে যোগ দিয়ে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত হয়েছেন, নয়তো ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গী সংগঠনে যোগ দেয়ার জন্য বিদেশে চলে গিয়েছেন, আবার অনেকে ফিরেও এসেছেন। গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে এক সঙ্গে চার শিক্ষার্থী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর গত ৫ ডিসেম্বর আরও এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জেনারেল ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। এক সঙ্গে একই এলাকা থেকে পাঁচ শিক্ষার্থী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটিতে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলে তাদের সন্ধানে মাঠে নামে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। নিখোঁজ শিক্ষার্থী সাঈদ আনোয়ার ॥ সোমবার রাতে বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে, যাতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে সাঈদ আনোয়ার খান (১৮) নামে এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন। সর্বশেষ নিখোঁজ হওয়া সাঈদ একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া করতেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হন সাঈদ। এরপর থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। জিডিতে উল্লেখ করা হয়, তার বয়স ১৮। উচ্চতা ৬ ফুট। গায়ের রং শ্যামলা। বাসা থেকে বরে হওয়ার সময় কালো প্যান্ট, কালো গেঞ্জি পরনে ছিল তার। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায়নি। খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রয়েছে। পরে রাতে বনানী থানায় জিডি করা হয়। সাঈদের বাবার নাম আনোয়ার সাদাত খান, মা জেনিফার হক খান। তার বাসা বনানীর ‘বি’ ব্লকে। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বি এম ফরমান আলী জিডির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তাকে খুঁজতে পুলিশ কাজ করছে। নিখোঁজ সাঈদের নিকটাত্মীয় মামার সঙ্গে কথা বলা হলে নিখোঁজের বিষয় নিশ্চিত করা ছাড়া আর কিছুই বলতে রাজি হননি তিনি। তিনি একটি বেসরকারী মোবাইল ফোন অপারেটরের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। নিখোঁজ চার শিক্ষার্থী তরুণ ॥ গত ১ ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকেই একসঙ্গে আরও চার যুবকের নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছে পুলিশ। বনানী কাঁচাবাজার থেকে একসঙ্গে নিখোঁজ চারজন হলেন- সাফায়াত হোসেন, জাইন হোসেন খান (পাভেল), মেহেদি হাওলাদার ও মোঃ সুজন। এদের মধ্যে সাফায়াত ও জাইন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেহেদি বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র। আর সুজন ড্যাফোডিল আইটি থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে কোর্স করে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। রাজধানীর বনানী থেকে একসঙ্গে নিখোঁজ চার শিক্ষার্থীকে উদ্ধারে মাঠে নেমেছে বনানী থানা পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বনানী থানা সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বনানী কাঁচাবাজার এলাকার নর্দান ক্যাফে রেস্তরাঁয় চার তরুণকে একসঙ্গে দেখা যায়। এরপর থেকেই তারা নিখোঁজ হন। ওই এলাকা থেকে একই সময়ে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনায় বনানী থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও নিখোঁজের ৬ দিনেও তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেট্র্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, বনানী কাঁচাবাজার থেকে তারা নিখোঁজ হন। তাদের উদ্ধারে থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে। তাদের আনুমানিক বয়স ২০-২৫ বছর। আমরা তদন্ত করছি। তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। নিখোঁজদের পরিবারের কথা ॥ পাভেলের বাবা রাসেল খান বলেছেন, তার ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্র্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। গত বৃহস্পতিবার সর্বশেষ পরীক্ষা দেয়। তিনি আরও বলেন, তার ছেলের আচরণে কখনও সন্দেহজনক কোন কিছু দেখেননি। সুজন ও পাভেল সম্পর্কে জানা গেছে, তারা বনানী গলফ হাইটস ভবনে থাকত। সুজন নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের এশিয়াটিক অফিসে চাকরি করেন। থাকতেন আলী যাকেরের বাসাতেই। আর পাভেল থাকতেন তাদের নিজেদের বাসায়। নিখোঁজ মেহেদীর চাচা মাহাবুব হোসেন তালুকদার বলেছেন, মেহেদী একটি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গত ২৬ নবেম্বর ঢাকায় এসে ওঠেন ফুপুুর বাসায়। গত বৃহস্পতিবার তার ল্যাপটপে একটি সফটওয়্যার আপডেট দিতে সুজনের কাছে আসেন। এরপরই নিখোঁজ হন। সাফায়েত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন আগে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, ধর্মীয় বিষয়ে নিয়মিত স্ট্যাটাস দিতেন। এর মধ্যে বিতর্কিত ইসলামী চিন্তাবিদ বিল্লাল ফিলিপসের নানা বক্তব্য নিয়মিত পোস্ট দিতেন। এছাড়া ধর্মীয় নানা পোস্ট শেয়ারও করতেন। সাফায়েত ও পাভেল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাভেলের মাধ্যমে সুজন ও মেহেদীর সঙ্গে সাফায়েতের পরিচয়। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ চার তরুণের নিখোঁজ রহস্যের কিনারা করতে র‌্যাব-পুলিশ ইতোমধ্যে তাদের ব্যক্তিগত, বন্ধুদের সেলফোন নম্বরের কললিস্ট নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখছে। তারা কার কার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তাদের সঙ্গে কারা যোগাযোগ করতেন সবকিছু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের এক কর্মকর্তা মনে করেন, সবকিছু বিশ্লেষণ করে তারা উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কোন জঙ্গীগোষ্ঠী মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে সিরিয়া পাঠানোর কথা বলে কোনো গোপন জঙ্গী আস্তানায় তুলে নিয়ে থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়।
×