ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আগামী মাসে কাজ শুরুর সম্ভাবনা ;###;মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে

বাস্তবে রূপ নিচ্ছে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল, পাল্টে যাবে চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

বাস্তবে রূপ নিচ্ছে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল, পাল্টে যাবে চট্টগ্রাম

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ উপমহাদেশের প্রথম নদীর তলদেশে দীর্ঘ টানেল নির্মিত হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশে। সুড়ঙ্গপথে এপার-ওপারের মেলবন্ধন চট্টগ্রামকে রূপ দেবে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউনে। ৩৯ ফুট থেকে ১১৮ ফুট গভীরতার দুই টিউববিশিষ্ট এই টানেলের ভেতর দিয়ে যাবে মীরসরাই-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ, যা এক সময় সম্প্রসারিত হবে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। এমনই এক স্বপ্নের পরিকল্পনা এখন আর অলীক নয়। যৌথভাবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিত্তিস্থাপনের পর এখন শুধু কর্মযজ্ঞ শুরুর অপেক্ষা। জানুয়ারি মাসেই কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করছেন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনায় বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করে চলেছে একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প। পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা এবং কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল এ সরকারের অনেক বড় উদ্যোগ। এরমধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের টানেল প্রকল্পটি অভিহিত হয় স্বপ্নবিলাসী এক পরিকল্পনা হিসাবে। কিন্তু সেই স্বপ্নের ঘোর কেটে গিয়ে টানেল এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। অর্থ ছাড়করণ এবং সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার অনাপত্তিপত্র গ্রহণের মধ্য দিয়ে আগামী মাসেই এই কাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ বাবদ ক্ষতিপূরণ হিসাবে ইতোমধ্যে ৩১০ কোটি টাকা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে। আরও ১১০ কোটি টাকা দেয়া হবে শীঘ্রই। যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করা হচ্ছে ভূমির মৌজামূল্যের দেড়গুণ অর্থ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূমি মালিকদের নোটিস দেয়া হয়েছে। জমির উপযুক্ত মূল্য নির্ধারিত হওয়ায় তাদেরও আপত্তি নেই। টানেল নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য এর সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। নেভাল পয়েন্ট এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে কর্ণফুলী টানেলের ফলক। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী ইফতেখার কবির মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক আগেই সিদ্ধান্ত হলেও প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে। অর্থ ছাড়করণের ক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী কিছু কমপ্লায়েন্স পূর্ণ করতে হয়। এর ৯০ ভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। জেলা প্রশাসনও এরমধ্যেই ৮৫ একর জমি বুঝিয়ে দিয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই কাজ শুরু করা সম্ভব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করবে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। অভিজ্ঞ এ প্রতিষ্ঠান চীন ছাড়াও বিভিন্ন দেশে টার্নেল নির্মাণ করেছে। টানেলের অর্থায়ন করছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত এক্সিম ব্যাংক। ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ ছাড়করণের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে। পাওয়া গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), পরিবেশ অধিদফতর, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো), নগর উন্নয়ন অধিদফতর এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) ছাড়পত্র। বাকি অনাপত্তিপত্রগুলো পাওয়া যাবে চলতি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে। নকশা অনুযায়ী কর্ণফুলী টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ হাজার ৫ মিটার বা ৩ কিলোমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। চট্টগ্রাম নগরীর নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে তলদেশে ঢুকে তা বেরুবে ওপারে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি স্থান দিয়ে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে ৩৯ ফুট (১২ মিটার) থেকে ১১৮ ফুট (৩৬ মিটার)। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। এর একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেক টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল। এর উপর দিয়ে দুই লেনে গাড়ি চলাচল করবে। পাশে হবে আরও একটি টিউব । মাঝে ফাঁকা থাকবে ১১ মিটার। যে কোন বড় যানবাহন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারবে এই টানেল দিয়ে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজটি হাতে নেয়া হয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বিবেচনায় নিয়ে। মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এই সড়ক যাবে টানেলের ভেতর দিয়ে। চট্টগ্রাম নগরীর বাস্তবায়নাধীন আউটার রিং রোড কাজ করবে টানেলের এপ্রোচ সড়ক হিসাবে। নগরী থেকে টানেল অতিক্রম করে মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার যাবে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে। সেই আনোয়ারাতেই বাস্তবায়িত হবে চীনা ইকোনমিক জোন। উত্তর দিকে এই মেরিন ড্রাইভ চলে যাবে বাস্তবায়নাধীন দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল মীরসরাই ইকোনমিক জোন পর্যন্ত। আবার মীরসরাই ইকোনমিক জোন সম্প্রসারিত হচ্ছে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত। এছাড়া মীরসরাই-সীতাকু-ের মাঝামাঝি এলাকায় নির্মিত হবে মাঝারি সাইজের একটি সমুদ্র বন্দর। নগরীর হালিশহর এলাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করছে বে-টার্মিনাল। তাছাড়া মীরসরাই ইকোনমিক জোন কেন্দ্র করে ছোট একটি বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও রয়েছে। চট্টগ্রামকে ঘিরে গ্রহণ করা হয়েছে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোন এক সময়ে মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিদ্যুত হাব। মহেশখালীর মাতারবাড়িতে হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। এই কর্মযজ্ঞ পৃথকভাবে চলমান থাকলেও মূলত সরকারের মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনারই অংশ। টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনসহ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে পাল্টে যাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের চেহারা, আর এর ছোঁয়া লাগবে সারাদেশে। কারণ, এই চট্টগ্রাম হয়ে খুলে যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বার। চট্টগ্রামে এই প্রকল্পগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে সময়ের বাস্তবতায়। ইতোমধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ সড়কেরই পাশে হচ্ছে ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে। প্রধান দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগ আরও সহজ করতে রেল লাইন ডাবল করা হচ্ছে। সবকিছু করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যত বিবেচনায় নিয়ে। চট্টগ্রামকে ঘিরে চীনের আগ্রহও বেশি। কারণ, চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া চীন আনোয়ারায় একটি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছে, দেশটি মীরসরাইয়েও নিজেদের জন্য একটি শিল্পজোন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর এখন রয়েছে শাহ আমানত সেতু ও কালুরঘাটে জরাজীর্ণ একটি রেল সেতু। ওই সেতুটি ভেঙ্গে সেখানে নতুন সেতু স্থাপনের মধ্য দিয়ে বোয়ালখালীর সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা হবে। মেরিন ড্রাইভের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরও একটি সেতু। কিন্তু তিনটি সেতুই পিলারের হলে কর্ণফুলীতে পলি জমে নাব্য কমে যেতে পারে। যদি তেমন হয় তাহলে বন্দর অচল হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৃতীয় প্রকল্পটি হয় ‘কর্ণফুলী টানেল’।
×