ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের স্বীকৃতি দেয়ার ৪৫ বছর উপলক্ষে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভায় বক্তারা

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রধান হুমকি পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

 দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রধান হুমকি পাকিস্তান

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রধান হুমকি হচ্ছে পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশ পাকিস্তানের জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের শিকার সেসব দেশের উচিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠন করা। মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলতি মাসে ভারত সফরকালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বীরযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা পদক প্রদান কার্যক্রমের সূচনা করবেন। বাংলাদেশকে ভারতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ৪৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ও উপমহাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরীর কন্যা ডাঃ নুজহাত চৌধুরী, শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম, মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনন্য, বহুমুখী এবং বহুমাত্রিক। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বন্ধন ছাড়াও দু’দেশের ভবিষ্যত একইসূত্রে গাঁথা। ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর ক্রমবর্ধমান ভূমিকা প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রীর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতে সরকারী সফর, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফর এবং ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলতি মাসের প্রস্তাবিত সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান সুসম্পর্ক গভীরতর হওয়াসহ সার্বিকভাবে এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ এবং দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে বলে আশা করা যায়। সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও একটি যৌথ সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে আমাদের দু’দেশের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমরা আশা করি, ১৯৭১ সালে যে অনুভূতি ও সহযোগিতার আবহ তৈরি হয়েছিল সে রকম একটি আবহ এই সময়েও বর্তমান যা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ-ভারত একে অপরের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাবার পাথেয় হবে। ফলশ্রুতিতে, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালে একটি ‘উন্নত দেশ’এ পরিণত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ১৯৭১ সালের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। এই কর্মপন্থার মূল চেতনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনবদ্য নেতৃত্ব হতে উৎসারিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের সম্মুখীন করা এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারী বিদেশী ব্যক্তিত্বদের ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ হিসেবে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়াÑএসবই সরকারের সেই আন্তরিক প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ । পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের স্বাধীনতা অর্জন এবং এগিয়ে যাওয়ার পথে যারা অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়াস নিয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকার জন্য আমাদের নিকটতম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’ এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে। এছাড়া ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যেসকল সুহৃদ ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী এই মাসের ভারত সফরকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুুদ্ধে শহীদ সকল ভারতীয় বীরযোদ্ধাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা পদক প্রদান কার্যক্রমের সূচনা করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আজকের এই দিনটি (৬ ডিসেম্বর) আমাদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী এবং বন্ধু রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সেই থেকে বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকার গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই দিনটিকে স্মরণ করে আসছে। এই বিশেষ দিনে আমি মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গ, জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙালী ও বিদেশী নাগরিক নির্বিশেষে সকলের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়াও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। একই সঙ্গে ভারতের যে সকল বীর যোদ্ধা এ যুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। আলোচনা সভায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যে গতি ছিল, বর্তমানেও সেই গতিতে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। দুই দেশের এই সম্পর্কের ভিত রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। দুই দেশই এখন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে চলেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ভারতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ৪৫তম বার্ষিকীতে আমরা বিশেষভাবে আনন্দিত। দুই দেশই স্থল সীমানা ও সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তি করেছে। এই সমস্যার সমাধান করাটা ছিল খুবই কঠিন। তবে দুই দেশই সেই সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে বলে তিনি জানান। আলোচনার মূল প্রবন্ধে শাহরিয়ার কবির বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রধান হুমকি হচ্ছে পাকিস্তান। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ওপর নির্মিত আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘জিহাদ উইদাউট বর্ডার’এ পাকিস্তানের সিনেটর ( বর্তমানে মন্ত্রী) হাসিল বেজেঞ্জো বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান হচ্ছে বিশ্বে এমন একটি দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজ দেশে জঙ্গীবাদকে মদদ দেয়া হয়। আমার জানা নেই বিশ্বে অন্য কোন দেশ এমনটি করে কিনা’। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশ পাকিস্তানের জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের শিকার সেসব দেশের উচিত হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার একটি নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠন করা। জঙ্গী মৌলবাদকে রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামরিকভাবে, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে ও আদর্শিকভাবে কীভাবে মোকাবেলা করা যায় এ নিয়ে এসব দেশের সরকার ও নাগরিক সমাজের ভেতর সমঝোতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। শাহরিয়ার কবির বলেন, ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশ তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। জামায়াতিরা অসহায় রোহিঙ্গাদের দারিদ্র্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যবহার করে সাহায্যের নামে তাদের জিহাদের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে। ২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপির আমলে আমরা ১৭টি জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা তৈরি করেছিলাম, যেগুলো জামায়াতের উদ্যোগে গঠিত হয়। তিনি বলেন, জঙ্গী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেবে, তার মাসুল দিতে হবে সেদেশের নিরীহ রোহিঙ্গাদের এবং বাংলাদেশে কাছে এ পরিস্থিতি কখনও কাম্য হতে পারে না। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে জামায়াতি এনজিওদের কাজ কঠোর নজরদারিতে আনার আহ্বান জানান তিনি। শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
×