ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আরেকটি বিআরটি লাইন হচ্ছে;###;অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক;###;কাজ হবে তিন ধাপে;###;সম্ভাব্যতা যাচাই ও নক্সা প্রণয়নের কাজ শেষ

বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ ৪০ মিনিটে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ ৪০ মিনিটে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট রুট করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিটে পাড়ি দেয়া যাবে প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়ক। যা এখন অনেক সময় চার ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। যাত্রীদের ওঠানামার জন্য থাকছে ১৬টি স্টেশন। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প দূরত্বের মধ্যে এ প্রকল্প যানজট নিরসনে খুব একটা কাজে আসবে না। এজন্য রাজধানীর আশপাশের জেলাসমূহের মধ্যে বিআরটি প্রকল্প ধাপে ধাপে সম্প্রসারণের তাগিদ দিয়েছেন তারা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিনটি ধাপে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এরমধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মহানগরীর যানজট নিরসনে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হতে মহাখালী পর্যন্ত দ্রুতগতির বাস সার্ভিস বা বিআরটি রুট নির্মাণ হবে। বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আগামী মাসে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে ঢাকায় আসছে বিশ্বব্যাংকের একটি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশন। জানা গেছে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট রুট-৩ হবে বিমানবন্দর হতে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত। প্রথম পর্যায়ে বিমানবন্দর হতে মহাখালী পর্যন্ত, ২য় ও ৩য় পর্যায়ে যথাক্রমে মহাখালী থেকে গুলিস্তান এবং গুলিস্তান থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত। প্রয়োজনীয় অর্থায়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক ১ম পর্যায়ের কাজ দ্রুত শুরু করতে চায়। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক বিআরটি রুট-৩ নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং বিস্তারিত নক্সা প্রণয়নে কাজ শেষ করেছে। রবিবার বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নতুন এই প্রকল্পের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত ২২৫ কিলোমিটার সড়ক চারলেনে উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তারা এ বিষয়ে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনার আওতায় ইতোমধ্যে বিমানবন্দর হতে জয়দেবপুর পর্যন্ত বিআরটি রুট-৪ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মন্ত্রী জানান, বিশ্বব্যাংক তিন বছর আগে বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল প্রকল্প পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পে অর্থায়নে রাজি হয়েছিল। কিন্তু মাঝে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে আগ্রহ দেখায়নি। এখন তারা বাংলাদেশের কর্মকা-ে পুরোদমে নিয়োজিত হতে চাচ্ছে এবং তিনধাপে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। প্রথম ধাপে ২৫০ মিলিয়ন ডলারে মহাখালী পর্যন্ত কাজটি করতে চায়। আমরা দ্রুত কাজ শুরু করতে বলেছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর যানজট নিরসন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নুরুল ইসলাম নাজেম জনকণ্ঠকে বলেন, গাজীপুর থেকে- কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, যানজট নিরসনে বিআরটি প্রকল্পটি আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে মাওয়াঘাট পর্যন্ত এই রুট সম্প্রসারণ করা গেলে সুফল মিলবে। সম্ভব হলে এই প্রকল্পটি ময়মনসিংহ-নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাসমূহ পর্যন্ত নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান নক্সা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাময়িক কিছু সুবিধা বাড়বে। সীমিত আকারে হলেও সর্বোপরি কিছু র‌্যাপিড ট্রানজিটের ব্যবস্থা হবে। ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম এলাকায় রাস্তা না বাড়ালে যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনার অভাবে ঢাকার চার ভাগের মধ্যে এক ভাগের বেশি রাস্তা ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু নিউইয়র্কে ছোট রাস্তা হলেও ওয়ানওয়ে করা আছে। সেখানে ব্যবস্থাপনা ভাল থাকায় চলাচলে সমস্যা নেই। আমাদের দেশের রাস্তা দখলমুক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে কোন সমস্যা হবে না বলেও মনে করেন তিনি। রাজধানীর যানজট সমস্যা সমাধানে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) প্রণয়ন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এই পরিকল্পনায় ২০০৫ সালে তিনটি মেট্রো রেল ও তিনটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। রাজনৈতিক বাস্তবতা, আর্থিক যোগান না হওয়া, সরকারের আন্তরিকতার অভাবসহ নানা কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিক এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেনি। গাজীপুর-এয়ারপোর্ট বিআরটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোঃ আফিল উদ্দিন বলেন, বিআরটি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দ্রুত মানুষ গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন। ফলে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ছেড়ে গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহী হবে। রাস্তার মাঝখানে স্টেশন হবে। ২০টি ইন্টারসেকশন ফ্লাইওভার ও দুটি ইউটার্ন থাকবে। ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি বাস পরিচালনা করবে। তিনি জানান, প্রকল্পটি এক ডিসেম্বর ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। থাকছে ৩২ স্টেশন ॥ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল (কেরানীগঞ্জ) পর্যন্ত বিআরটি রুটের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ দশমিক চার কিলোমিটার। প্রকল্পের একটি অংশে ১৬টি স্টেশনের মধ্যে রয়েছে-এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন, খিলক্ষেত, ক্যান্টনমেন্ট, আর্মি স্টেডিয়াম, কাকলি, আমতলি, মহাখালী বাস টার্মিনাল, বিজিপ্রেস, হাতিরঝিল, বেইলি রোড, কাকরাইল, পল্টন, ফুলবাড়িয়া, নয়াবাজার, কদমতলী সার্কেল হয়ে ঝিলমিল প্রকল্পে গিয়ে শেষ হবে। বাস ডিপো থাকবে একটি। ফ্লাইওভার থাকছে দুটি। ১৮ মিটার দীর্ঘ আর্টিকুলেটেড বাসে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা প্রায় ১৪০ জন। আন্ডারপাসের সংখ্যা থাকছে ৩০টি। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে ডিজাইনের অর্থ পাওয়া গেছে। এছাড়া অপর অংশে থাকছে আরও ১৬টি স্টেশন। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটির অগ্রগতি ॥ যানজট নিরসনে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণে চীনের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। চীনের গেজহুবা গ্রুপ ৮৫৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘের এ প্রকল্পের জন্য ১৬ কিলোমিটার বিআরটি লেইন, ৩২ কিলোমিটার ফুটপাথ ও ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন নির্মাণ করে দেবে। আগামী ৩০ মাসের মধ্যে এ নির্মাণ কাজ শেষে উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে বলে আশা করছে সরকার। সম্প্রতি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক একরাম উল্লাহ ও গেজহুবা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াং রোমেন এ চুক্তিতে সই করেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য হবে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড বিআরটি লেন থাকবে। বাকি ১৬ কিলোমিটার থাকবে সমতলে। নির্মাণ করা হবে ছয়টি ফ্লাইওভার। দুই প্রান্ত গাজীপুর ও বিমানবন্দরে থাকবে দুটি টার্মিনাল, আর মাঝের পথে হবে ২৫টি স্টেশন। প্রতি দুই থেকে ৫ মিনিট পরপর স্টেশন থেকে বাস ছাড়বে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছতে সময় লাগবে ৫০ মিনিট। ১৮ মিটার দৈর্ঘের ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এ পথে। বাস ভাড়া আদায় হবে ইলেক্ট্রনিক স্মার্ট কার্ডে। প্রকল্পে মূল নির্মাণের পাশাপাশি কিছু সড়ক প্রশস্তকরণ, সার্ভিস সড়ক ও গাজীপুরে তিন কিলোমিটার ড্রেনেজ নির্মাণ, আট লেনের টঙ্গী সেতু ও ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ মিলিয়ে এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সরকারের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি দাতা সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) এতে অর্থায়ন করছে। বুয়েটের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানদ-ে বিআরটি নির্মাণের ক্ষেত্রে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হওয়ার কথা ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলার। আর বাংলাদেশ এই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১ কোটি ৩১ লাখ ডলার। সেক্ষেত্রে গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটিএ হবে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উন্নত বিশ্বের আদলে চালু করা হচ্ছে দ্রুতগতির বিআরটি সার্ভিস। বাসগুলো চলাচলের জন্য ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নির্মাণ করা হবে আলাদা বিশেষ লেন। কেউ অননুমোদিতভাবে বিআরটি টিকেট বা পাস বিকৃত বা জাল করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ- বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। বিআরটি লেন নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট আইন-২০১৬’-এর খসড়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। আইনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে খসড়ায় বলা হয়, জনগণকে স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত ও উন্নত বাসভিত্তিক গণপরিবহন সেবা দিতে এ আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর এবং নরসিংদী জেলায় আইনটি কার্যকর হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি জেলা শহরগুলোতে এ সার্ভিস চালু করা হবে। আর এ লাইন নির্মাণ সরকারী—বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেও করা যাবে। এ লাইনে বাস পরিচালনা করতে সরকারের কাছে লাইসেন্স নিতে হবে। বিআরটি বাস ছাড়া অন্য কোন ধরনের যানবাহন ওই লেনে প্রবেশ করতে পারবে না। সরকার বিআরটি যাত্রীদের ভাড়ার হার নির্ধারণ করে দেবে। প্রতিটি কোচে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু ও প্রবীণদের জন্য নির্ধারিত সংখ্যক আসন সংরক্ষিত রাখা হবে। পাশাপাশি বিআরটি ও এর যাত্রীর বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে আইনের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের ২৬ জুন যোগাযোগ খাতের বড় দুই প্রকল্প নির্মাণের আনুষ্ঠানিক যাত্রা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরমধ্যে ছিল মেট্রোরেল ও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)।
×