ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবিরের করা রিটের রায়ে হাইকোর্ট

দেশের সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

দেশের সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতা বিরোধীদের নামে যেসব স্থাপনা আছে তা মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই সব স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব ও খুলনার মেয়রকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। স্ব^াধীনতাবিরোধীদের নামে স্থাপনা নামকরণ প্রত্যাহারের নির্দেশনা চেয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। আগামী ১ মার্চ পরবর্তী আদেশের জন্য বিষয়টি তালিকায় আসবে বলে জানিয়েছেন রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার একে রাশিদুল হক। শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস। আদেশের পর রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার এ কে রাশেদুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দ- পেয়েছেন, তাদের নামেও স্থাপনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকার সেগুলো পরিবর্তন করেনি এবং পরিবর্তনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগও নেই। বাঙালী হিসেবে আমাদের জন্য এটা লজ্জাজনক ও অগ্রহণযোগ্য। খান এ সবুরের নাম সংবলিত যে সকল স্থাপনা রয়েছে ওই সব নামের বিষয়ে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তার বিষয়ে আরও একটি প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া ২০ জন স্বাধীনতাবিরোধীর নাম সংবলিত একটি তালিকা যুক্ত করে সম্পূরক এক আবেদন করা হলে আদালত ওই আদেশ দেন। ২০১৭সালের ১ মার্চ পরবর্তী আদেশের জন্য বিষয়টি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের তালিকায় আসবে। তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ও স্থাপনায় থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে শিক্ষাসচিব ও স্থানীয় সচিব ও খুলনা মেয়রকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইনজীবী বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম রাস্তাঘাট, সড়ক ও স্থাপনা থেকে মুছে ফেলতে চেয়ে সম্পূরক এক আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত এ আদেশ দেন। এর আগে স্বাধীনতাবিরোধী খানে সবুরের নামে খুলনার একটি সড়ক এবং কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটির শাহ আজিজুর রহমানের নাম সরানোর দাবিতে ২০১২ সালে রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির। ওই রিটের শুনানিতে ২০১২ সালে এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট খুলনায় খান এ সবুর ও বাংলাদেশ ইসলামিক (কুষ্টিয়া) ইউনির্ভাসিটির (শাহ আজিজুর রহমান অডিটরিয়াম) এই দুটি স্থাপনা থেকে তাদের নাম সরানোর। কিন্তু সুপ্রীমকোর্টের আদেশের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও কোন স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম না সরানোর কারণে আমরা এই আবেদন করি। আজ ওই আবেদন শুনানি করে এই আদেশ দেন। স্বাধীনতাবিরোধী যে ২০ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে তারা হলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ-প্রাপ্ত বিএনপির সারবক মন্ত্রী আব্দুল আলিম, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ কায়সার আলী, মৌলভী বাজারের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এনএম ইউসুফ আলী। সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়া খান মজলিস, ফরিদপুরের আব্দুর রাজ্জাক মিয়া, মৌলবী বাজারের মাহতাব উল্লাহ, গাইবান্ধার আব্দুল আজিজ ও আব্দুল জব্বার, নোয়াখালীর তরিকুল্লাহ, ঝিনাইদহের মিয়া মনসুর আলী, কুমিল্লার রেজাউর রহমান, নাটোরের আব্দুর সাত্তার খান মধু মিয়া ও কাছির উদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণের মোঃ তামিমুল এহসান ও মোহাম্মদ উল্লাহ, নেত্রকোনার আব্দুর রহমান, মেহেরপুরের মিয়া মনসুর আলী ও সাবদার আলী এবং ঝিনাইদহের সফি আহমেদ। এর আগে ২০১৫ সালের ২৯ নবেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী খান-এ-সবুরের নামে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় কি কি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার তালিকা চেয়েছিল হাইকোর্ট। তারও আগে গত বছরের ৩ নবেম্বর এক আদেশে একই বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত ‘খান-এ-সবুর’ সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনতে আদালতের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলেছিল। জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানও ষাটের দশকে মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে ১৯৭২ সালে তাকেও দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তার নামেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিলনায়তনের নামকরণ হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে স্থাপনা, সড়ক, অবকাঠামোর নামকরণ স্থগিত চেয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও সাংবাদিক গবেষক শাহরিয়ার কবীর। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৪ মে রুলসহ খান-এ সবুর ও শাহ আজিজুর রহমানের নাম ব্যবহার স্থগিতের আদেশ দেয় হাইকোর্ট। উল্লেখ্য, হাইকোর্টের ঐ রুলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের নামে থাকা সড়ক, স্থাপনা ও অবকাঠামোর নাম পরিবর্তনের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সেসবের নামকরণ কেন করা হবে না এবং যারা ওই নামকরণের জন্য দায়ী, তাদের কেন বিচারের আওতায় আনা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। আদালতের ওই নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে না জানিয়ে গত ২৫ আগস্ট আরেকটি আবেদন করেন মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির। এরপর হাইকোর্ট যে আদেশ দেয়, তাতে ‘খান-এ-সবুর’ সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ব্যবহার করতে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেইসঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাহ আজিজুর রহমান’ মিলনায়তনের নামও প্রত্যাহার করতে বলা হয়। এরপর ১ নবেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ‘সব খানে সবুর খানের ভক্ত?’ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার পরও যুদ্ধাপরাধীদের নাম সরানোর কাজে দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী খান-এ-সবুরের (সবুর খান) নামে কোন স্থাপন থাকতে পারবে না বলে হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছে। আদেশের দুই মাস অতিবাহিত হলেও খুলনা সিটি কর্পোরেশন ( কেসিসি) এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। কেসিসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা আদেশের কপি পাননি। শিরোনামের একটি প্রতিবেদন রবিবার আদালতের নজরে আনেন আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার পরও যুদ্ধাপরাধীদের নাম সরানোর কাজে দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে শুনানি করেই ৩ নবেম্বর সাত দিনের মধ্যে ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনার আদেশ দেয় আদালত। রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার একে রাশিদুল হক বলেন, গত বছরের ২৯ নবেম্বর আদালত খান-এ -সবুরসহ যারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ছিল, রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্যের নামে যত স্থাপনা ছিল তাদের সবার নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। এর মঙ্গলবার ( ৬ ডিসেম্বর ২০১৬) ২০ নামের আরও একটি সম্পূরক আবেদন করা হলে আদালত উপরোক্ত আদেশ প্রদান করেছেন। মুসলিম লীগের নেতা খান-এ-সবুর পাকিস্তান আমলে ছিলেন আইয়ুব খানের মন্ত্রী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে বিচার শুরুর সময় প্রকাশিত ছয় শ’ স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীর তালিকাতেও তার নাম ছিল। সেই স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের নামেই পরে যশোর রোডের নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ থেকে কলকাতার দমদম পর্যন্ত এই সড়ক ধরেই একাত্তরে লাখো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। তাদের দুর্দশা দেখেই আমেরিকান কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, যা সে সময় বিশ্বকে নাড়া দেয়। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই সড়ক হয়েই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে শত্রুমুক্ত যশোরে পৌঁছান। জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানও ষাটের দশকে মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে ১৯৭২ সালে তাকেও দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তার নামেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিলনায়তনের নামকরণ হয়।
×