ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাকিল আর নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাকিল আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবুল হক শাকিল আর নেই (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। হার্ট এ্যাটাকে তার মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা। তার মৃত্যু অস্বাভাবিক কি-না তা নিশ্চিত হতে পুলিশ অন্তত আটজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া রেস্তরাঁয় নিহতের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সোমবার রাতে কে কে নিহতের সঙ্গে ছিল এবং যোগাযোগ হয়েছে, সে বিষয়েও তদন্ত চলছে। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের সামদাদো নামে একটি জাপানী রেস্তরাঁয় তার মৃত্যু হয়। মুত্যুর খবরে রেস্তরাঁটিতে দ্রুত ছুটে যান নিহতের পরিবারের লোকজন, মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। নিহতের গ্রামে বাড়ি ময়মনসিংহে চলছে শোকের মাতম। শাকিলের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন শোকবার্তা দিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, বিমানের নাট-বল্টু খুলে পড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রানে বেঁচে যাওয়ার পরপরই তারই বিশেষ সহকারীর এমন মৃত্যু বেশ রহস্যের জন্ম দিয়েছে। ঘটনা দুটি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুর বারোটার দিকে গুলশান-২-এর ৩৫ নম্বর সড়কের ৭২ নম্বর বাড়িটিতে সামদাদো চাইনিজ কুইসিন রেস্টুরেন্টটি থেকে মাহবুবুল হক শাকিলের লাশ উদ্ধার হয়। পরে তাকে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ওই রেস্তরাঁটিতে যাতায়াত করতেন। মাঝেমধ্যেই সেখানে রাতযাপন করতেন। বেশিরভাগ সময়ই তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব থাকত। সেখানে হরদম আড্ডা দিতেন। সোমবার তিনি ওই রেস্তরাঁয় যান। সেখানে আড্ডা দেন। সঙ্গীরা বিদায় হয়ে যান। রাতের খাবার খেয়ে তিনি রেস্তরাঁর একটি কক্ষে ঘুমিয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে যাতায়াত করার কারণে সেখানকার অনেকেই তার বিষয়টি জানত। মাহবুবুল হক শাকিলকে রাতে ঘুমানোর পর নিজে নিজেই ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত ডাকা বারণ ছিল। তবে অন্যান্য দিন সকাল দশটা বা এগারোটার দিকে তিনি উঠতেন। মঙ্গলবার দুপুর বারোটা নাগাদও তার কোন দেখা না পেয়ে হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার দরজায় নক করতে থাকেন। ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরও তার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে বিছানায় মৃতের মতো পড়ে থাকতে দেখেন। গায়ে হাত দিয়ে তার মৃত্যুর বিষয়টি অনুমান করতে পারেন রেস্তরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পুলিশ দ্রুত তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা মাহবুবুল হক শাকিলকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত থাকা হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া বিকেল ৫টার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিনের সদস্য ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রেস্তরাঁর ভেতর প্রবেশ করেন। তারা ঘটনাস্থল থেকে বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত আলামতের মধ্যে মাহবুবুল হক শাকিল যে টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করেছেন সে টেবিলে থাকা উচ্ছিষ্ট খাবার ছাড়াও থালা-বাসনসহ অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। রেস্তরাঁয় শাকিলের ব্যবহার করা নানা জিনিসপত্র ও হাতের ছাপের ছবি আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত খাবার ও অন্যান্য আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এদিকে মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর খবরে রেস্তরাঁয় ছুটে যান আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জ্বালানি ও বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান, ৭১ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মুন্নী সাহা ও সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিকসহ পরিবারের সদস্যরা। হাসপাতাল থেকে মাহবুবুল হক শাকিলের মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটায় রেস্তরাঁটির বাইরে জ্বালানি ও বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার সকালে ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর লাশ নেয়া হবে নিজ বাড়ি ময়মনসিংহ জেলা সদরের বাঘমারায়। সেখানে মাগরিবের নামাজের পর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর পারিবারিক করবস্থানে বুধবারই দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। ঘটনাস্থল ঘুরে এসে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, মাহবুবুল হক শাকিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মাহবুবুল হক শাকিলের বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় হলেও তার জন্ম হয়েছিল টাঙ্গাইলে ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। তার পিতা এ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। মা শিক্ষক। মাহবুবুল হক শাকিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। নিহতের স্ত্রী আইনজীবী। তাদের সংসারে একটি মেয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মাহবুবুল হক শাকিল ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে নবগঠিত আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সেল সিআরআই পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর আগে তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতালাভ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিবের দায়িত্ব পান তিনি। চার বছর পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে অতিরিক্ত সচিব মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার কবিতা বেশ প্রশংসিতও হয়েছে। তিনি নিয়মিত কবিতা লিখতেন। ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ ও ‘মন খারাপের গাড়ী’ নামে তার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর ১৬ ঘণ্টা আগে মাহবুবুল হক শাকিল ফেসবুকে ‘এলা, ভালবাসা, তোমার জন্য’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সর্বশেষ দেয়া স্ট্যাটাসটি ছিল মূলত একটি কবিতা। ঢাকা মহানগর পুলিশের কূটনৈতিক জোনের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর প্রকৃত কারণটি পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ময়মনসিংহ থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার বাবুল হোসেন জানান, মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুতে ময়মনসিংহ শহরের বাঘমারার নিজ বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শাকিলের বাসায় আত্মীয়স্বজনসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হন। ধর্মমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান শাকিলের বাসায় যান। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। প্রতিদিনের মতো জেলা পরিষদের নিজ কার্যালয়ে কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন শাকিলের বাবা আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা। শাকিলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে জেলা পরিষদ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা খোকাকে বাঘমারার বাসায় নিয়ে যান। বলা হয় শাকিল অসুস্থ। কিন্তু এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শাকিলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মূর্ছা যান এ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা। মুহূর্তেই ভারি হয়ে ওঠে বাঘমারার বাসা ও এর আশপাশের পরিবেশ। খবর পেয়ে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন, ডিআইজি ময়মনসিংহ রেঞ্জ চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন, ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলমসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বাঘমারার বাসায় গিয়ে সমবেদনা জানান। পারিবারিক সূত্র জানায়, বুধবার দুপুরের পর শাকিলের লাশ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরে নিয়ে আসা হবে। জানাজা শেষে শহরের ভাটিকাশর কবরস্থানে শাকিলকে দাফন করা হতে পারে। তবে গফরগাঁওয়ের গ্রামের বাড়িতেও জানাজার জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে পারিবারিক সূত্রগুলো।
×