ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহম্মেদ মৃধার স্মৃতি

‘আলফাপুর যুদ্ধে এক পাকি কর্নেলসহ ২৫ সেনাকে হত্যা করি’

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

‘আলফাপুর যুদ্ধে এক পাকি কর্নেলসহ ২৫ সেনাকে হত্যা করি’

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘৭ ডিসেম্বর। বিকাল ৩টা। প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই। আমরা চারদিক থেকে শৈলকূপা পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ঘিরে ফেলি। আক্রমণ চলতে থাকে। তারাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। সে এক তুমুল যুদ্ধ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। যুদ্ধ চলতে থাকল সারারাত। গুলি চলল বৃষ্টিরমতো। কখনও কখনও থেমে থেমে। পুরো শহর থমথমে। ফজরের আজানের পর ওদের পাল্টা আক্রমণ কমতে থাকে। দিনের আলো ফুটতে থাকে। রাজাকারদের নাম ধরে তাদের স্যারেন্ডার করার নির্দেশ দিই। ৮ ডিসেম্বর দুপরের দিকে রাজাকাররা অস্ত্রসহ স্যারেন্ডার শুরু করে। ১৪ পাকসেনাকে গ্রেফতার করি। বিকেল ৫ টার দিকে পাকসেনাসহ রাজাকারদের ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে নিরস্ত্র অবস্থায় হস্তান্তর করি। মিত্রবাহিনী তাদের ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে নিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর আমরা শৈলকূপাকে পাকমুক্ত ঘোষণা করি।’- মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই শৈলকূপা মুক্তি দিবসের তথ্য তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহম্মেদ মৃধা। জানালেন, বেয়নেট চার্জ করে সেখানে হত্যা করা হয় ৩ রাজাকরাকেও। সোমবার জনকণ্ঠের নেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে ঝিনাইদহের এই মুক্তিযোদ্ধা তুলে ধরেন যুদ্ধদিনের স্মৃতি। স্মৃতির পাতা উল্টে বার বার হয়ে ওঠেন আবেগতাড়িত। থেমে থেমে, বলে যাচ্ছিলেন কখনওবা একটানে। তুলে ধরেন যাতায়াত ব্যবস্থায় সেই সময়কার পশ্চাৎপদ শৈলকূপার কথাও। হাঁটার বিকল্প ছিল একমাত্র নদীপথ। কৃপালপুর থেকে শৈলকূপা যেতেই লাগত ৪ ঘণ্টা। আলফাপুর সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়ার স্মৃতি তুলে ধরে এক প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ভাদ্রমাস। পানিতে থৈ থৈ। তখন পুরোদেশ পানিতে ভাসছে। রাস্তাঘাটে চলার কোন পথ নেই। যেতে হয় একমাত্র নৌকায়। আবাইপুর গ্রামের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্প পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে শ্রীখোলা বাজারে এসে রাইফেলকে গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে নদী পার হয়ে আলফাপুর গ্রামে উঠি। ওখানে একটি নদী ও খালেরপারে পাকসেনাদের এ্যাম্বুস করি। ঠিক দুপুরের পর পাকসেনারা খালপার দিয়ে আধাকিলোমিটার হেঁটে ব্রিজ পার হওয়ার চেষ্টা করলে এ্যাম্বুস থেকে গোলাবর্ষণ করি। সেখানে আমরা ২১ মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কামান্ডার ছিলেন সেনাবাহিনীর আব্দুছ ছাত্তার ও ইপিআরের হাবিলদার মেজর রানু সাহ। ওই যুদ্ধে এক পাক কর্নেল আমাদের কাছে নিহত হয়। ২৪ থেকে ২৫ সেনাকে আমরা নিহত করে অস্ত্রশস্ত্র নদীতে ফেলে দিই। এক পর্যায়ে বাকি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে নিরাপত্তার কারণে আমরা ওখান থেকে সরে গিয়ে পাংসা থানাধীন বিভিন্নগ্রামে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমাদের এলাকায় ফিরে আসি। যুদ্ধ চলাকালীন এটি ছিল আমাদের এক সফল অভিযান।’ যুদ্ধে যেমন সফল হয়েছেন তেমনি ব্যর্থ হয়েছে তাদের অভিযানও। ব্যর্থ অভিযানের স্মৃতি তুলে ধরে আবাইপুর ইউনিয়নের এই প্রাক্তন চেয়ারম্যান বলেন, ‘১৪ আগস্ট। আবাইপুরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে আমাদের ২১ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। সাধারণ মানুষ মারা যান ৩ জন। ওই যুদ্ধে আমাদের পরাজয় ঘটে। এক পর্যায়ে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই।’ যুদ্ধে ঠিক কবে অংশ নিলেন এমন প্রশ্নে তার উত্তর। ‘মার্চ-এপ্রিলের মাঝামাঝি। ধারাগঞ্জ কুমার নদীর ব্রিজের ওপর পুলিশের লোকেরা আমাদের এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওখানে ব্রিজের উত্তরপাশে (কুষ্টিয়া অংশে) রাস্তার মাটি কেটে ফাঁকা করে চাটাই বিছিয়ে রাখে। এটা যুদ্ধের প্রথমলগ্নে। এই এলাকায় এটাই প্রথম প্রতিরোধ।’ তিনি বলেন, ‘কুষ্টিয়া থেকে খুব ভোরে যশোর সেনাবাহিনী ঘাঁটির উদ্দেশে পাকসেনারা রওনা হলে ওখানে এসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের শিকার হয় । সেখানে কিছু পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। এক পর্যায়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পালায়ন করে। ওই প্রতিরোধে যারা অংশ নেয় তার মধ্যে আনসার কমান্ডার আবেদ আলী ও ভেরিবাড়ির গোলাম মোস্তফা। গোলাম মোস্তফা আমার আত্মীয় হওয়ায় আমাদের এলাকায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মগোপনে চলে আসে। গোলাম মোস্তফার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মুক্তার আহম্মেদ মৃধা বলেন, ‘সেখানে তার সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। তার কাছ থেকে আমি একটি চাইনিজ রাইফেল সংগ্রহ করি। যুদ্ধের প্রথমদিকে অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল। এ সময়ে আবু আহমেদ সোনা মোল্লা অন্য কোথাও থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল সংগ্রহ করে প্রকাশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি শ্রীপুর এলাকায় আকবর চেয়ারম্যান আকবর বাহিনী নামে একটি বাহিনী গড়ে তোলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। তখনও আমাদের এলাকার লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমায়নি।’ তিনি বলে যাচ্ছেন। একটানে বলে গেলেন। মুক্তার মৃধার ভাষ্য, ‘ফরিদপুর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যখন ভারতে যাওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে আমাদের এলাকা অতিক্রম করছে, আমাদের এলাকার হিন্দুরাও ভারতে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে তখন এলাকার পাকিপন্থীরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয় লুটপাট। ঘরে ঘরে আতঙ্ক। সব হারানোর ভয়। এমনকি নারীর সম্ভ্রমও।’ তিনি বলেন, ‘তখন আমি পার্শ¦বর্তী রতনপুর, চারভাগিনী ও যুগ্মী গ্রামের এসব অসহায় লোকের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। চাইনিজ রাইফেল নিয়ে পাশে দাঁড়াই। নারীর সম্মান রক্ষার্থে রাতজেগে পাহারা দিতে শুরু করি। জেগে জেগে সারারাত। এক সময় তারা ভারতের উদ্দেশে রওনা দিলে আমি আমাদের এলাকায় চলে আসি। পরবর্তীতে সোনা মোল্লা তার দলে থাকার জন্য বললেন। মূলত আমি তার সঙ্গে থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি।’ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘২০০ থেকে ৩০০ লোক নিয়ে আকবর বাহিনী নামে একটি বাহিনী গড়ে ওঠে। শৈলকূপার পূর্বাঞ্চলে সোনা মোল্লার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আরেকটি বাহিনী। ইতোমধ্যে এই বাহিনীতে ভারতীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাও যোগ দেয়। মাগুরা-শ্রীপুর-শৈলকূপার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা এসে জড়ো হতে থাকে। কারণ, এলাকাটি ছিল ভৌগোলিকভাবে পশ্চাৎপদ। যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল একমাত্র নৌপথ অথবা হেঁটে।’ ভারতে ট্রেনিং নেয়ার স্মৃতি উল্লেখ করে সম্প্রতি নিজ এলাকায় আক্রমণের শিকার হওয়া এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘পরে ট্রেনিং নিতে চলে যাই ভারতে। প্রথমে ভারতের বেতাই ক্যাম্পে। সেখানে কয়েকদিন থেকে চলে যাই ভারতের রানাঘাটে। সেখানে আামদের এক থেকে দেড় মাস ট্রেনিং দেয়া হয়। দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ। আক্রমণ চলছে সর্বত্র। সে কারণে দ্রুত আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফিরে এসে ১৩ থেকে ১৪ জন একসঙ্গে রহমত-আলী-মন্টু কমান্ডারের দলে যোগদান করি। এটা ছিল ৮ নং সেক্টর।’ নবেম্বরের একটি স্মৃতি উল্লেখ করে মুক্তার মৃধা বলেন, ‘মাগুরা জেলা থেকে ১০০ থেকে ১৫০ মুক্তিযোদ্ধা আমাদের কামান্না গ্রামে এসে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ও তার আশপাশে অবস্থান নেয়। ২৭ নবেম্বর রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনী এসব মুক্তিযোদ্ধার ওপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ২৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বাকি মুক্তিযোদ্ধার কেউ কেউ আহত হয়েছিলেন। ভারত থেকে এসে ওই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের এখানে ছিল। তারা আক্রান্ত হয়। তাদের এই আক্রান্ত হওয়া আমাকে আজও ব্যথা দেয়।’ সবশেষের প্রশ্ন ছিল, এখন কেমন আছেন। এই মুক্তিযোদ্ধার উত্তর, ‘আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারা নিগৃহীত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া সবাই আমাদের ভুলে গেছে।’ আপনি ঠিক কেমন আছেন? মহাখালীর একটি রেস্টুরেন্টে বসে নেয়া এই সাক্ষাতকারে তার উত্তরÑ ‘ভাল-খারাপ মিলিয়ে আছি। সুখ-দুঃখের মধ্যে আছি। আমি তো রাষ্ট্রের বাইরে নই।’ তবে ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেননি সম্প্রতি তার ওপর ঘটে যাওয়া হামলার কথা! বলেননি যুদ্ধে ‘আমি’; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে বলেছেন যুদ্ধে ‘আমরা’।
×