ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রধান ১২ বাধা দূর করার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রধান ১২ বাধা দূর করার উদ্যোগ

এম শাহজাহান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে প্রধান ১২ বাধা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তার এ সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বেশকিছু নতুন চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং অতীতে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে দুই দেশ। এছাড়া পানিবণ্টন ও ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, এবং কানেকটিভিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন খাতে প্রায় ২০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। একই সঙ্গে ভারতের আর্থিক সহায়তায় চলমান বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা হবে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সৈন্য শহীদ হয়েছেন তাদের সম্মাননা জানানো হবে এ সফরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১৮ ডিসেম্বর দুদিনের সফরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যাচ্ছেন। তাঁর এ সফরকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ঢাকা-দিল্লী। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো নিয়ে কী কী চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হবে সেই কার্যসূচী প্রস্তুত করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অধিদফতর। আর এ সফর সামনে রেখে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সফরের প্রস্তুতির লক্ষ্যে পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহিদুল হক এরই মধ্যে দিল্লী ঘুরে এসেছেন। গত ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বৈরী সম্পর্কের অবসান হয়। ওই সময় দু’দেশের মধ্যে ৫০ দফার যে যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়, সেটিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘পথ নক্সা’ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে বাংলাদেশ সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের মতো বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগ নিরসনে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখনও সই হয়নি। এছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে যেসব বাধা রয়েছে তার তেমন অগ্রগতি নেই। ফলে যুগ যুগ ধরে যে বাণিজ্য বৈষম্য দেশের প্রতিকূলে রয়েছে তা কমানো যাচ্ছে না। শুল্ক-অশুল্কজনিত সমস্যা রয়েছে। আছে অবকাঠামোগত নানা ধরনের সমস্যা। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, পুরো বিষয়টি দেখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কাজটিও তাদের। তবে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, সম্প্রতি দিল্লীতে সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বর্ডারহাট চুক্তি নবায়নসহ বাণিজ্য বিষয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত ব্রিক-বিমসটেক আউটরিচ বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী যোগ দিয়েছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রীও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির কৌশল নির্ধারণে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার ভারত সফর করছেন। বেশকিছু অগ্রগতি আছে। তিনি বলেন, ভারত বড় দেশ, তাদের অর্থনীতির আকারও অনেক বড়। তাই ভারতের বিনিয়োগ আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিভিন্ন ফোরামে সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে কানেকটিভিটি খাতে বেশকিছু চুক্তি সই হতে পারে। ভারতের বিশাখাপত্তম ও হলদিয়া বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল চুক্তি হতে পারে। এছাড়াও চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ভারত কী পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে সে সম্পর্কিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছরের জুনে বাংলাদেশ সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ১২ বাধা ॥ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১২টি প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই অবকাঠামো সমস্যা। বাংলাদেশ সরকার এসব সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে যেসব ইস্যু বাধা হিসেবে কাজ করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বুড়িমারী-চেংড়াবান্ধা ও তামাবিল-ডাউকি স্থলবন্দরের দুর্বল অবকাঠামো, ঢাকা-গৌহাটির মধ্যে দ্রুত বিমান সার্ভিস চালু না করা, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে নৌপ্রটোকলের আওতায় ব্রহ্মপুত্র নদে এখনও পোর্ট অব কল স্থাপন না করা, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়া, কোস্টাল শিপিং পুরোপুরি চালু না করা ও বেশিসংখ্যক বর্ডারহাট স্থাপন না করা, শুল্ক-অশুল্কজনিত সমস্যা, সহজে ভিসা না পাওয়া প্রভৃতি। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এসব সমস্যা সমাধানে করণীয় নির্ধারণ এবং পর্যালোচনা করা হবে। দেশে ভারতীয় বিনিয়োগ ॥ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ার পরও ভারতীয় বিনিয়োগ দেশে সেই অর্থে বাড়েনি। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানে ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, একক ও যৌথ মালিকানায় ভারতীয় প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২৬টি কৃষিভিত্তিক শিল্পে, খাদ্য শিল্পে ৬টি, টেক্সটাইল শিল্পে ৩৫টি, প্রিন্টিং, পাবলিশিং ও প্যাকেজিংয়ে ৭টি, ট্যানারি ও রাবারে ৩টি, রাসায়নিক খাতে ৫৪টি, গ্যাস ও সিরামিকসে ৪টি, প্রকৌশল খাতে ৩৬টি এবং সেবা খাতে ৫৯টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ এসেছে। যদিও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ, টাটা, বিড়লা ও মিত্তাল ব্যবসা সম্প্রসারণে অন্য দেশে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। অথচ পাশের প্রতিবেশী বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগের চিত্র সন্তোষজনক নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভারতীয় মালিকানাধীন ৬২টি প্রতিষ্ঠান মাত্র ২১ কোটি ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ মালিকানায় ১৬৮টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৮ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভারতের ২৩০টি প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ মাত্র ৫৯ কোটি ডলার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের স্বার্থেই ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার এখই সময়। এজন্য বাংলাদেশে অনেক বেশি ভারতীয় বিনিয়োগের প্রয়োজন। এটি হলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনেদের ভারসাম্য রক্ষায় সহজ হবে। তিনি বলেন, শূন্য শতাংশ শুল্ক সুবিধায় ভারতে পণ্য রফতানির সুযোগ পাওয়া গেছে। এ সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যথেষ্ট বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের।
×