ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বেড়ানো ॥ আধুনিক লাইফস্টাইলে অপরিহার্য

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬

বেড়ানো ॥ আধুনিক লাইফস্টাইলে অপরিহার্য

মধ্যবিত্ত আড়মোড়া ভেঙ্গেছে। বদলেছে তাদের লাইফ স্টাইল। আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার অংশ হিসেবে লাইফস্টাইলে ঢুকে পড়ছে বেড়ানোর নেশা। দু’চারদিনের ছুটি পেলে অনেকেই দুম করে বেরিয়ে পড়েন কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কাপ্তাই কিংবা রাঙ্গামাটি অথবা প্রকৃতির অন্য কোন সান্নিধ্যে। নগরের রুদ্ধশ্বাস ব্যসত্মতা থেকে বেরিয়ে দু’দ- প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানো জরুরীও হয়ে ওঠে কখনও কখনও। বিশেষ করে শিশুদের জন্য। অল্প বয়সে শিক্ষার যে বিশাল বোঝা ওরা কাঁধে নিয়েছে সামান্য সময়ের জন্য হলেও তা থেকে খানিক মুক্তি মেলে। যাদের সামর্থ্য আছে স্বল্প অবসরে তারা কাছেপিঠের অন্য দেশেও ঢুঁ মেরে আসেন। এর অন্যতম কারণ ভ্রমণের স্বাচ্ছন্দ্য। বাইরের দেশে যত স্বচ্ছন্দে বেড়ানো যায় দেশে ততটা পারা যায় না। অবকাঠামো এবং রাস্তা-ঘাটের বাস্তবতা সুখকর নয়। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, সেন্টমার্টিনের মতো বহুল পরিচিত পর্যটন স্থান ছাড়া অন্য কোথাও গেলে পুরোপুরি নিজ উদ্যোগে যেতে হয়। কক্সবাজারও পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তার ওপর রয়েছে মানসিকতার ঘোরপ্যাঁচ। কয়েক বছর আগে ইংরেজী নববর্ষ বরণ করতে কক্সবাজারে গিয়ে অনেকেই তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। ঢাকা থেকে এক মাস আগে বুকিং দিয়ে এমনকি অগ্রিম টাকা দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে হোটেলে গিয়ে দেখেন রুম বেদখল। অনেকে সারাদিন ঘুরে অবসন্ন হয়ে রাতে কটেজে ফিরে দেখেন শুয়ে আছে অন্য পর্যটক। হোটেল-কটেজ কর্তৃপক্ষ এর শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করতে পারে না। ঘটনা কখনও সংঘর্ষে রূপ নেয়। এ ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসা দরকার। দেশে বেড়ায় মূলত মধ্য শ্রেণী। উচ্চবিত্তের মনোযোগ দেশের বাইরে। দেশের মধ্যে বেড়ানো যাতে নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ হয় সেদিকে সরকার ও পর্যটন সংক্রান্ত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি মনোযাগী হওয়া দরকার। দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই এখনও ব্যক্তিগত যোগাযোগে বেড়াতে যেতে হয়। পর্যটনের সমন্বিত পরিকল্পনার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। এত চমৎকার দেশ আমাদের! প্রতিটি জেলায় পর্যটক আকর্ষণের মতো একাধিক জায়গা রয়েছে। একটু মনোযোগ, সামান্য আন্তরিকতা নিয়ে এগুলে এ খাত আয়ের অন্যতম উৎস হতে পারে। ভারত-নেপাল তাদের দেশের একটুখানি বিশেষায়িত জায়গাকেও পর্যটকদের সামনে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করে। পর্যটক সেখানে সহজে পৌঁছতেও পারে। আমাদের দেশের সৌন্দর্য ওদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ছোট ছোট পর্যটন বলয় তৈরি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে ভিন্ন ভিন্ন জোনে ভাগ করা যায়। যেমন পুরো পার্বত্য এলাকা নিয়ে একটি বলয় হতে পারে। উত্তর জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে হতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলো নিয়ে নৌ-বলয় হতে পারে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিয়ে হতে পারে। সমুদ্রসৈকত নিয়ে যেমন-কক্সবাজার, ইনানী, হিমছড়ি, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, ছেঁড়াদ্বীপ ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার পর্যটন বলয় হতে পারে। প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো আমাদের অমূল্য সম্পদ। এগুলো নিয়েও বলয় তৈরি করা সম্ভব। শুধুমাত্র প্রত্ন তত্ত্বের আকর্ষণেই বহু বিদেশী পর্যটক আসবে। অবকাঠামো, রাস্তা-ঘাট, পরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনাও সেভাবে তৈরি হবে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়বে। পর্যটন ম্যানেজমেন্ট এমন হবে যে, একজন পর্যটক শুধু ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রাথমিক কাজ সারবেন বাকি দায়িত্ব তাদের। এতে খরচ খানিক বাড়লেও নির্ঝঞ্ঝাট ভ্রমণের নিশ্চয়তায় পর্যটকরা এদিকে ঝুঁকবেন নিঃসন্দেহে। দেশের পার্বত্য এলাকায় গেলে দুঃখ হয়-বিদেশী পর্যটকরা শুধু কক্সবাজারই চিনল, বন-পাহাড়ের এ অপরূপ প্রকৃতি তাদের প্রায় অজানা। আমরা চেনাতে পারিনি, সে ব্যর্থতা আমাদের। বেড়ানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ কতটা বেড়েছে, দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ভিড় দেখলে তা বোঝা যায়। দেশের, বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গত বছর একত্রিশ ডিসেম্বর কক্সবাজারে বিচ কার্নিভ্যালের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পর্যটন বর্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ঘোষণা অনুযায়ী পর্যটনবর্ষের কার্যক্রম চলবে তিন বছর। দু’হাজার ষোলো এর প্রথম বছর। তিন বছরে দশ লাখ বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করার সরকারী টার্গেট রয়েছে। কিন্তু তিন বছরের ‘পর্যটনবর্ষ’র প্রথম বছরটি শেষ হয়ে গেলেও বিদেশ থেকে কত পর্যটক এসেছে সে সম্পর্কে পর্যটন কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। এর অর্থ পর্যটন শিল্প ও পর্যটক আকর্ষণের বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এ জন্য যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার সরকারিভাবে তার অভাব রয়েছে। পর্যটন শিল্পে বড় অবদান রাখতে পারে বেসরকারী খাত। কিন্তু সে জন্যও সরকারী পর্যায়ে প্রাথমিক কিছু উদ্যোগ থাকা জরুরী; যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত। ইংরেজরা ভারতে রেললাইন বসিয়েছিল রাজ্যপাট আরও মজবুত করতে। সে উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়েছিল নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি ঘটেছে আরও বড় ঘটনা যা হয়ত তাদের ভাবনাতে ছিল না। ওই পথ ভারতবাসীকে নিজের দেশ চিনিয়েছিল। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছিল। এই জানা এবং জানানো আত্মোপলব্ধির নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, যা স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত গড়িয়েছিল। রেল পথের সুবাদে ভারতে পর্যটন শিল্পের বিকাশও দ্রুততর হয়েছে এবং বেড়ানোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ও দেশের যে কোন প্রদেশে বেড়াতে গেলে তা টের পাওয়া যায়। এত বিশাল বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ডের পুরোটাই বিকশিত করতে পেরেছে পর্যটন স্থান হিসেবে। পূজার ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া ওদের উৎসবের অংশ। খুব সাদাসিধেভাবেই বেরিয়ে পড়ে। বেড়ানোর সংস্কৃতি আধুনিক মনসিকতার পরিচয় দেয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ উন্নত পৃথিবীর আধুনিকতা ধারণ করে সমান তালে এগোচ্ছে, পর্যটনেও তেমন সম্ভব। প্রয়োজন সদিচ্ছা ও সঠিক পরিকল্পনা। [email protected]
×