ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে বিজয় সরকারকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়ার দাবি

প্রকাশিত: ০১:৪১, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে বিজয় সরকারকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়ার দাবি

রিফাত-বিন-ত্বহা, ডুমদি থেকে ফিরে ॥ স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বিজয় সরকার কবিগান গেয়ে যে টাকা উর্পাজন করতেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করতেন। মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা চারণকবি বিজয় সরকারের বসতভিটা এখন সংরক্ষণের অভাবে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। আগাছা এবং ময়লা-অবর্জনায় সৌন্দর্য হারিয়েছে কবির স্মৃতিধন্য নড়াইলের ডুমদি গ্রামটি। বিজয় সরকারের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটিও সম্পূর্ণ পাকা হয়নি। প্রায় দুই কিলোমিটার কাঁচা রাস্তার কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বর্ষাকালে নৌকার ওপর ভরসা রাখতে হয়। এতে করে প্রতিনিয়ত বিপাকে পড়েন দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা। ‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে বিজয় সরকারকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়ার দাবি উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে প্রায় ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ডুমদিতে ভবন ও বিজয় মঞ্চ নির্মিত হলেও কোনো তত্ত্বাবধায়ক না থাকায় অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে কবির ব্যবহৃত খাটসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ধূলোময় হয়ে আছে। নেই টিউবওয়েল ও টয়লেট ব্যবস্থা। এখনো পর্যন্ত পৌঁছায়নি বিদ্যুৎ। এছাড়াও বিজয় স্মৃতিসংগ্রহশালা নির্মাণের দাবি পূরণ হয়নি। বিজয় সরকারের আত্মীয় বিভাষ চন্দ্র সিকদার বলেন, কবির বসতভিটা এলাকায় বর্তমানে আমার পরিবারই বসবাস করছে। অন্যরা ডুমদি ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছেন অনেক আগেই। কবির বসতভিটা এবং বাসভবন দেখার কেউ নেই। খুবই এলোমেলো অবস্থা। থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। রয়েছে টয়লেট ও পানির সমস্যা। তাই দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফিরে যান। বিজয়ভক্ত টাবরা গ্রামের স্বপন কুমার সরকার বলেন, বিজয় সরকারের বাড়িটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল থাকায় পর্যটকরা এখানে আসতে পারেন না। বিশেষ করে দুই কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা থাকায় সীমাহীন কষ্ট করতে হয়। লোহাগড়ার দিঘলিয়া গ্রামের ভিক্টোরিয়া আক্তার (২৩) বলেন, বিজয় সরকারের গানের কোনো স্বরলিপি না থাকায় গান চর্চা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকমুখে শুনে আমরা নবীন শিল্পীরা বিজয় গীতি গেয়ে থাকি। বাংলাদেশ এবং ভারতে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে বিজয় সরকারের অসংখ্য গানের সুর। এসব গান ও সুর সংগ্রহ করে স্বরলিপি আকারে প্রকাশ করার দাবি জানাচ্ছি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে। ভবিষ্যতে যেন বিজয়গীতির সুর কেউ বিকৃত করে প্রকাশ করতে না পারেন। চারণকবি বিজয় সরকার ফাউন্ডেশনের যুগ্ম-আহবায়ক এসএম আকরাম শাহীদ চুন্নু বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বিজয় সরকারের অবদান রয়েছে। তিনি কবিগান গেয়ে যে টাকা উর্পাজন করতেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করতেন। তাই ‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে বিজয় সরকারকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়ার দাবিসহ জাতীয় চারণকবির স্বীকৃতি প্রদান, বিজয় সরকারের নামে নড়াইলে ফোকলোর ইন্সটিটিউট নির্মাণ এবং পাঠ্যপুস্তকে কবির রচনা ও জীবনী অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানাচ্ছি। চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারী বলেন, লোককবি বিজয় সরকারের স্মৃতিধন্য ডুমদি গ্রামে স্মৃতিসংগ্রহশালা নির্মাণসহ তার বসতভিটা রক্ষণাবেক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। জেলা প্রশাসক হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, বিজয় সরকারের বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণসহ তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিকৃতি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া বিজয় সরকারের বাড়িতে যাতায়াতের রাস্তাটিও পাকাকরণের ব্যবস্থা করা হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা বিজয় সরকার বার্ধ্যকজনিত কারণে ১৯৮৫ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের হাওড়ার বেলুডে পরলোকগমন করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের নিভৃতপল্লী ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিজয় সরকার। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন তিনি। প্রকৃত নাম বিজয় অধিকারী হলেও সুর, সঙ্গীত ও অসাধারণ গায়কী ঢঙের জন্য ‘সরকার’ উপাধি লাভ করেন। ১৮০০ বেশি গান লিখেছেন। সুরের মূর্ছনায় আজো বেঁচে আছেন হাজারো মানুষের হৃদয়ে। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন বিজয় সরকার।
×