ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফুসফুসের ক্যান্সার ও করণীয়

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

ফুসফুসের ক্যান্সার ও করণীয়

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির অধিৎবহবংং ঈধষবহফবৎ অনুযায়ী প্রতিবছরই নবেম্বর মাস ফুসফুসের ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসাবে পালন করে আসছে। আমাদের দেশেও সেমিনার ও সিমপোজিয়ামের মাধ্যমে এই মাসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়ে থাকে। ক্যান্সার শব্দ শুনার সঙ্গে সঙ্গেই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন সহজ করে বলা যায় যে, ক্যান্সার হচ্ছে শরীরের কিছু কোষ সমষ্টি যার সঙ্গে স্বাভাবিক কোষগুলোর সামঞ্জস্য নেই। এই অসামঞ্জস্যতা চেহারার দিক থেকে এবং কাজের দিক থেকেও। ইহাকে আমরা শরীরের বাড়তি কোষ সমষ্টি বলতে পারি যা আকৃতি ও প্রকৃতি উভয়দিক থেকেই শরীরের স্বাভাবিক কোষ থেকে ভিন্ন। তাই বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও গণ-সচেতনতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ক্যান্সার ভীতি অনেক কমেছে। ফুসফুস মানবদেহের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। বক্ষ পিঞ্জরের ডানে ও বামে দুইটি ফুসফুস অবস্থিত এর মাধ্যমে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করি। ফুসফুসে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। রোগ হলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায়। কিছু কিছু ফুসফুসের রোগ ভাল হয়ে যায়। ক্যান্সার রোগ হলে একটি কষ্টকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই ক্যান্সার একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি। বর্তমান বিশ্বে পুরুষদের সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার সবার শীর্ষে। মেয়েদের ফুসফুসের ক্যান্সারের হারও বেড়েছে। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর প্রতি পাঁচটির ভেতর একটি হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সার মধ্যবয়স্ক ও বয়স্কদের এই রোগের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি এক শ’ ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৮৭ জনের দীর্ঘদিন ধরে এবং অধিক হারে ধূমপানের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে ব্যক্তি প্রতিদিন ২০টি সিগারেট বা বিড়ি সেবন করে তার ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা অধূমপায়ীদের থেকে ২০ গুণ বেশি। পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবেও রোগ হতে পারে। ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুর মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ মৃত্যু ফুসফুসের ক্যান্সারজনিত কারণে হয়ে থাকে। সুতরাং কেবলমাত্র তামাকের ব্যবহার ছেড়ে দিলেই এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। তামাকের ধোঁয়া শ্বাসনালীর অভ্যন্তরীণ দেয়ালের ক্ষত সৃষ্টি করে যার ফলে কোষের আকৃতির অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে। এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরবর্তীকালে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। সিগারেট বা বিড়ির ধোঁয়ার ক্যান্সার সৃষ্টির অনেক উপাদান বিদ্যামন। তাছাড়া আর্সেনিক, পরমাণুবিক রশ্মি বিকিরণ, এসবেস্টস, ক্রোমিয়াম যৌগ, আলকাতরা জাতীয় সামগ্রী, ভিনাউল ক্লোরাইড, ইউরেনিয়ামের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অধিক। রোগের লক্ষণগুলো সহজে সারছে না এমন কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর, শব্দ করে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া, খেতে অসুবিধা ওজন কমে যাওয়া। যখন ফুসফুসের বাইরে অন্যস্থানে ছড়িয়ে যায়। যেমন অস্থিতে ছড়িয়ে গেলে প্রচ-হারে ব্যথা, মাথায় চলে গেলে বমি হওয়া, মাথা ব্যথা, লিভার বা যকৃতে চলে গেলে যকৃত বড় হয়ে যাওয়া এমনকি জ-িসে আক্রান্ত হওয়া। রোগ নির্ণয় করার জন্য ধূমপানসহ রোগীর সঠিক ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে কফ পরীক্ষা (ক্যান্সার কোষ), ব্রংকোসকোপি এফএন এসিএফএনএবি হিস্ট্রোপ্যাথলজি, সিটি স্ক্যান এবং এমআরআইয়ের প্রয়োজন হয়। কোন কোন সময় পেট সিটির মাধ্যমে রোগের বিস্তৃতি শনাক্ত করা হয়। ফুসফুস ক্যান্সার চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যান্সারের আকার, ব্যপ্তি ও হিস্ট্রোপ্যাথলজি রিপোর্টের ওপর। মূল চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো যেমনÑ সার্জারি, রেডিওথেরাপি,, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেট থেরাপি। সার্জারি করা হয় যখন ক্যান্সার উৎপত্তি স্থল সীমাবদ্ধ থাকে এবং অধিকাংশ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় শল্য চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা অধিক। রেডিয়েশন থেরাপির/বিকিরণ চিকিৎসার মূলভিত্তি ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষের ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করা কিন্তু নিকটবর্তী স্বাভাবিক কোষের যেন অতি সামান্য ক্ষতি সাধিত হয়। রেডিয়েশন চিকিৎসা ব্যবহৃত হয় একাকী অথবা সার্জারির সঙ্গে। অনেক সময় টিউমারের প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বা ব্যথা কমানোর জন্য। যখন সকল ক্যান্সার কোষ সার্জারের মাধ্যমে অপসারণ করা যায় না, তখন সার্জারির পরে আবার রেডিয়েশন দেয়া হয়। শরীরের বাহিরে থেকে বঞ্জনরশ্মি ও কোবাল্ট যন্ত্রের মাধ্যমে রেডিয়েশন দেয়া হয়। আফটার লোডিং সিস্টেমের মাধ্যমে কোন কোন ক্যান্সারে তেজষ্ক্রিয় বস্তু যেমন রেডিয়াম, সিজিয়াম, কোবাল্ট সরাসরি ক্যান্সার কোষের মধ্যে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিকে ব্রেকিথেরাপি বলা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসা ও বিকিরণ চিকিৎসা একসঙ্গে অথবা আগে বা পরে ক্যান্সার কোষ বিধ্বংসী ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়। বস্তুত রোগ ও রোগীর অবস্থা ভেদে শল্য চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি, কোমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। তবে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা পেলে ক্যান্সারের সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। কিছু কিছু ওষুধ টার্গেট থেরাপি হিসেবে ফুসফুসের ক্যান্সারে ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সার রোগ কোন ছোয়াচে না সংক্রামক ব্যাধি নয়। তাই রোগীকে আলাদা করে না রেখে পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আচরণ করা উচিত। তাতে রোগীর মনোবল আরও বৃদ্ধি পাবে। পরিশেষে ক্যান্সার চিকিৎসার মূলকথা দিয়েই শেষ করছি- ‘সূচনায় পড়লে ধরা, ক্যান্সার রোগ হয় যে সারা’ অধ্যাপক ডাঃ কাজী মনজুর কাদের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।
×