ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

বিদায় আলেপ্পো ক্লাউন

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

বিদায় আলেপ্পো ক্লাউন

যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর আলেপ্পো এবং মুহাফাযার (সিরিয়ার প্রদেশ) রাজধানী। এটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং রাজধানী দামেস্ক থেকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে। এ অঞ্চল পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম বড় শহর। শতব্দীকাল ধরে আলেপ্পো সিরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল এবং ইস্তানবুল ও কায়রোর পরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ছিল। আলেপ্পো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর। প্রায় ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্ব থেকে মানুষ আলেপ্পোতে বসবাস করছে। সিরিয়ার তেল-আস-সাওদা এবং তেল-আল-আনসারি শহরে খননকাজের মাধ্যমে জানা গেছে যে, আলেপ্পোতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে মানুষ বসবাস করছে। তখনকার সময়ে আলেপ্পো বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন করেছিল। আলেপ্পোর এমন দীর্ঘ ইতিহাসের কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান- ভূমধ্যসাগর ও মেসোপটেমিয়া এই দুই জায়গার মাঝে যা বৈদেশিক বাণিজ্যের সহায়ক। এছাড়া সিল্ক রোডের শেষপ্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে আলেপ্পোর উন্নতি হয়। এই সিল্ক রোড মধ্য এশিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। ১৮৩২ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত আট বছর, এ শহর মিসরের ইবরাহিম পাশার দখলে ছিল। ১৮৬৯ সালে যখন সুয়েজ খাল উদ্বোধন করা হয় তখন পণ্য আদান-প্রদান সমুদ্র দিয়ে নেয়া শুরু“হয় এবং এর ফলে ক্রমান্বয়ে আলেপ্পোর গুরুত্ব কমতে থাকে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে আলেপ্পোর উত্তরের একটি অঞ্চল তুরস্কের কাছে সমর্পণ করা হয়। এছাড়া ইরাকের মসুল শহরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ রেললাইনও তুরস্কের কাছে সমর্পণ করা হয়। ১৯৪০ সালে আলেপ্পো তার সমুদ্র এবং তুরস্কের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হারায়। বিগত কয়েক দশকে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সিরিয়ার পৃথকীকরণের ফলে এ অবস্থার আরও অবনতি হয়। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রাচীন আলেপ্পো এবং এর মধ্যযুগীয় স্থাপত্য-ঐতিহ্য অনেকাংশে অক্ষত থাকে। আলেপ্পোকে ইসলামী সংস্কৃতির রাজধানী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু সেই ২০১১ থেকে দেশটি জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। মানবতা ভূলণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে সিরিয়ার উদ্বাস্তু সমস্যা আজ বোধহয় আর কেবল সমস্যা হিসাবে আটকে নেই? সিরিয়া শরণার্থীদের ক্রমেই কঠোর হয়ে ওঠা জীবন হোক কিংবা ছোট্ট আয়লনের জলে ভেসে ওঠা মৃতদেহ, দেশটির হাজারো ট্র্যাজেডি বোধহয় শেষ হওয়ার নয়। এই ছিন্নমূল মানুষের জীবনের কিছু ছবি যখন হঠাৎ ভেসে ওঠে সংবাদমাধ্যমে, তখন তাদের অজান্তেই হয়ত তারা তৈরি করে শিরোনাম। তাদের করুণ অবস্থা দেখে চোখের জল ফেলছে গোটা বিশ্ব। ধুলোয় ঢাকা খালি পা দু’টো চেয়ারের সামনে ছড়ানো। এ্যাম্বুলেন্সের কমলা চেয়ারটা বছর পাঁচেকের খুদে শরীরের তুলনায় অনেকটাই বড়। কপাল থেকে গড়িয়ে নামা রক্ত ঢেকে দিয়েছে মুখের একটা দিক। চুলের উপরেও পুরু ধুলোর চাদর। সদ্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার আতঙ্ক ছায়া ফেলেছে চোখে মুখে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীতে যিনি সারাদিন শিশুদের মুখে হাঁসি ফোটাতেন সেই ‘ঈষড়হি ড়ভ অষবঢ়ঢ়ড়,’ গত ২৯ নবেম্বর এক বিমান হামলায় নিহত হন। ‘ক্লাউন অব আলেপ্পো’ প্রকৃত নাম আলান আল বাশা। ২৪ বছরের টগবগে যুবক যে কিনা বাচ্চাদের হাঁসি বিলিয়ে দেয়ার জন্য পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াত সম্প্রতি তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল বিমান হামলায়। আলান আল বাশা ছিলেন ঝঢ়ধপব ভড়ৎ ঐড়ঢ়ব এর পরিচালক। ‘স্পেস ফর হোপ’ ১২টি স্কুল, ৪টি সামাজিক সহায়তা কেন্দ্র পরিচালনা করে যেখানে ৩৬৫টি মতো শিশুর লালন পালন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই শিশুগুলো খুব অসহায় যাদের কেউ নেই, নেই বাবা-মা এমনি কি ঘরবড়ি। মাত্র দুই মাস আগে আলান আল বাশা তার বিবাহিত জীবন শুরু করেন তার হাতের মেহেদীর রং উঠার আগেই তাঁকে হারিয়ে যেতে হলো দূর দেশে।
×