ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

বিজয়ের মাসে ॥ সাদ-মনোয়ারের এশিয়া জয়

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

বিজয়ের মাসে ॥ সাদ-মনোয়ারের এশিয়া জয়

মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বে আমাদের পথ চলা শুরু ১৬ ডিসেম্বর। বিশ্ব মানচিত্রে নতুন ভূখ- আর জাতি হিসেবে নতুন পতাকায় প্রকাশিত এক জাতি। আমাদের জাতীয় জীবনে এই মাসটির গুরুত্ব তাই অপরিসীম। এই মহান বিজয়ের মাসের শুরুতেই তরুণ পরিচালক আবদুল্লাহ মোঃ সাদ চলচ্চিত্র মাধ্যমে জাতির জন্য বয়ে আনলেন এক অনন্য অর্জন সঙ্গে তরুণ অভিনেতা মোস্তফা মনোয়ার। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও প্রধান চলচ্চিত্র উৎসব সিঙ্গাপুর ফ্লিম ফেস্টিভ্যাল সাদের ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ সিলভার স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ডের জন্য মূল প্রতিযোগিতায় ১০টি ছবির মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছিল আগেই। গত ৩ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ মোঃ সাদ অর্জন করেন সেরা পরিচালকের গৌরব। আর মোস্তফা মনোয়ার নির্বাচিত হন মূল চরিত্রে সেরা অভিনেতা। এ ছাড়াও সাদের ছবি ছিল মূল প্রতিযোগিতায় প্রথম তিনটির মধ্যেই। বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্দশা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার কমতি নেই। ভাল গল্প, প্রযুক্তি, নিমার্তার অভাব। সরকারের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতা। ভাল ছবির হল না পাওয়া থেকে পাইরেসির প্রভাব নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু কথা কেবল কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, বাস্তব পরিস্থিতির কোন উন্নতি আমরা দেখতে পাইনি অন্তত গত তিন দশক জুড়ে। মাঝে মধ্যে কিছু ছবি আশার আলো ছড়ালেও ধারাবাহিকতা ছিল না তাতে। এমন যখন পরিস্থিতি তখন কিছু তরুণ নীরবে কাজ শুরু করেন বাংলা চলচ্চিত্রে। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী থেকে সম্প্রতি অমিতাভ রেজার মতো তরুণরা হাল ধরছেন বাংলা চলচ্চিত্রের। পাশাপাশি মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে শাকিব খান থেকে অনন্ত জলিলেরা করেছেন নতুন রক্ত সঞ্চালন। এই প্রজন্মের তরুণতম প্রতিনিধি আবদুল্লাহ্ মোঃ সাদ। নিভৃতচারী, স্বপ্নদ্রষ্টা এক তরুণ। মূলত বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাতা। মূলত বললে বোধকরি অন্যায় করা হয় তার ওপর। বরং বলা যায় আর্থিক প্রয়োজনে তার বিজ্ঞাপন নির্মাণ শুরু, কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেন, বেঁচে থাকেন সিনেমায়। তাই সামান্য আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের পর সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বপ্ন বাস্তবায়নে অর্থাৎ চলচ্চিত্র নির্মাণে। সঙ্গী তরুণ প্রজন্মের এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী মোস্তফা মনোয়ার, তাসনোভা তামান্না, তানভীরেরা। সাদ তার স্বপ্ন আঁকতে শুরু করেন সেলুলয়েডে। স্বপ্নের রং সাদাকালো। রঙিন ছবির বাজারে সাদাকালো পথে হাঁটা সাদ শুরুতেই জানিয়ে দেন তিনি ব্যতিক্রম। ঝুঁকি নিয়েছেন স্বপ্ন নির্মাণে সবর্স্ব হারানোর। আর এই ঝুঁকি বাংলা চলচ্চিত্রকে এনে দিয়েছে এক অনন্য সম্মান। তার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র ঠাঁই করে নিয়েছে মূল ধারার এশীয় চলচ্চিত্রে এবং তা সম্মানের সঙ্গে। নিভৃতচারী বলা এ জন্য যে, লাইভ ফ্রম ঢাকা সিলভার স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ডে ঠাঁই করে নেয়ার সংবাদে সময়ের অন্যতম গুণী নির্মাতা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘এক আওয়াজের দুনিয়ায় বাস করে আমি কেন এই সংবাদ জানলাম না? অনেকেই দেখি নীরবে শিকার করে আনতেছে বড় মাছ।’ শেষে লেখেন, আপনারা যারা আবদুল্লাহ মোঃ সাদকে চেনেন তাকে আমার অভিবাদন পৌঁছে দেবেন।’ নিভৃতচারী সাদের জন্য এই অভিবাদন আজ ফারুকীর একার নয় আমাদের সবার। মোস্তাফা মনোয়ার অভিনয় করেছেন লাইভ ফ্রম ঢাকার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। যিনি সিনেমায় আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক তরুণ। সাদাকালোতে এই ঢাকায় সাদ তুলে এনেছেন তার ও তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত চরিত্রগুলোকে। সাজ্জাদরূপী মনোয়ার তার অনিশ্চয়তা, প্রেম, দায়িত্ববোধ, অন্তর্গত ভ-ামি আর শেয়ার মাকের্টে আর্থিক ব্যর্থতায় পাওনাদার তাড়িত চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন তা আমাদের না বললেও চলে। বেস্ট পারফরমেন্স এ্যাওয়ার্ড তার হয়ে কথা বলেছে। তবে চরিত্রের প্রতি তার নিবেদন বোঝাতে একটি ঘটনার বর্ণনাই যথেষ্ট। আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে তিনি নিজ কর্মস্থলে শূটিং শুরুর অনেক আগে থেকেই ক্র্যাচ ব্যবহার শুরু করেন। সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করলে বলতেন এক্সিডেন্ট। চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার তার এই প্রচেষ্টা যে কারও জন্য হতে পারে উদাহরণ। উল্লেখ্য, সিনেমায় নবাগত মনোয়ার অভিনয় মাধ্যমে কাজ করে আসছেন ২০০৪ থেকে ছোট পর্দায়। কিন্তু কাজ করেন বেছে। আর সাদের মতোই নিভৃতচারী স্বভাবের কারণে প্রচারের আলো উঠে আসেনি সেভাবে। এই ছবি কেবল পুরস্কার অর্জনে নয়, শিল্পের প্রতি তরুণ প্রজন্মের ভালবাসার উদাহরণ হয়ে থাকবে। এখানে যারা কাজ করেছেন সবাই স্রেফ শিল্পকে ভালবেসে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়েছেন। ছবিতে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করা তাসনোভা তামান্নাকে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম পারিশ্রমিক নিয়ে। তামান্নার সোজা জবাব ছিল ‘সাদ এর কাছে ছবির গল্প শুনে আর বাজেটের সীমাবদ্ধতা জেনে, পারিশ্রমিক বিষয়টি আমাদের মাথাতেই আসেনি। আমরা স্রেফ কাজটি করতে চেয়েছি।’ শিল্প নিবেদন দাবি করে। আর সাদ, মনোয়ার, তামান্নারা শিল্পের বেদীতে নিবেদন দিয়েছেন উজাড় করে। তারই ফল এই বিজয়। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকার’ শূটিং শেষ হয়েছে একটানা ১৭ দিনে। সম্পাদনার সময় নিয়েছেন ৯ মাস। এ নিয়ে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আগের প্রতিবেদনে আমরা বলেছিলাম, যে ঢাকা সাদ আঁকতে চেয়েছেন তাতে সাদাকালোর কোন বিকল্প ছিল না। আর মনোয়ারের পুরস্কার প্রাপ্তি সর্ম্পকে ঝুঁকি নিয়েও নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলাম। এই বিজয় তাই প্রতিফলিত করল। সাদের ছবি একদল তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন নির্মাণের এক সমন্বিত প্রয়াস। আর সাদ সবাইকে বেঁধেছেন স্বাধীনতার বাঁধনে। এখানেই তার সার্থকতা। এ কথা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না, এই জাতির যে কোন ক্রান্তিকালে সঙ্কট উত্তরণে পথ দেখিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সাদ এখনও ছবি মুক্তির জন্য হল পাওয়া নিয়ে দ্বিধান্বিত। আমরা বিশ্বাস করি সে কালো মেঘে কেটে যাবে, সাদ মনোয়ার, তামান্নাদের হাত ধরে ফিরবে আমাদের চলচ্চিত্রের সুদিন। আপাতত অভিনন্দন সাদ-মনোয়ারের জন্য। [email protected]
×