ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা

তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় ফের পেছাল

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় ফের পেছাল

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় তৃতীয় বারের মতো পিছিয়ে আগামী ২২ জানুয়ারি তারিখে পুলিশকে সময় দিয়েছেন আদালত। গুলশান জঙ্গী হামলার তদন্ত শেষ করতে আরও কত সময় নিবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ এই জঙ্গী হামলার পাঁচ মাস পরও মূল পরিকল্পনাকারী, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো ব্যবসায়ী, নিহত জঙ্গীদের বাইরে তাদের সহযোগী জঙ্গীদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি তদন্তকারীরা। এই জঙ্গী হামলার সঙ্গে নিহত পাঁচ জঙ্গী ছাড়াও আরও অন্তত অজ্ঞাত দশ জঙ্গী রয়েছে যারা গ্রেফতারের বাইরে রয়ে গেছে। গ্রেফতারের বাইরে রয়ে গেছে এমন অন্তত আরও পাঁচজন সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য রয়েছে, যাদের গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় সোমবার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য আবারও পুলিশকে সময় দিয়েছে আদালত। সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম সাব্বির ইয়াছির আহসান চৌধুরী প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২২ জানুয়ারি ঠিক করে দেন। চলতি বছরের ১ জুলাই গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় নজিরবিহীন এই জঙ্গী হামলার ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল তৃতীয়বারের মতো পেছাল। এর আগে ২৩ অক্টোবর ও ২৪ আগস্ট প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা চালিয়ে দেশী-বিদেশীসহ ২৮ জন নিহত হয়। ওই হামলার ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্যও নিহত হন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়। এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। অজ্ঞাতনামা আরও ১০ জঙ্গীর হদিস নেই ॥ গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গী হামলার ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গীসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৫ জনের নামে মামলা করেছে পুলিশ। পুলিশ বাদী হয়ে গত ৪ জুলাই রাতে গুলশান থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী ও অস্ত্র ধারাসহ মোট পাঁচটি ধারায় মামলাটি দায়ের করার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কাছে তদন্তভার ন্যাস্ত করা হয়। গত ১ জুলাই রাতে গুলশানে হামলার ঘটনা ঘটে। যাতে দেশী-বিদেশীসহ মোট ২৮ জন নিহত হন। পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে নিহত পাঁচ জঙ্গীর সঙ্গে আরও অজ্ঞতনামা যে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে ১০ জনের কোন হদিস নেই। জঙ্গী হামলার ৫ মাস পরও এই ১০ জঙ্গীর অনেকেরই নাম পরিচয় উদ্ঘাটনসহ গ্রেফতার করা যায়নি। পাঁচ জঙ্গী সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য ॥ গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় আরও অন্তত পাঁচ জঙ্গীকে গ্রেফতার করার জন্য খোঁজ করছে তদন্তকারী পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এই পাঁচ জঙ্গীই সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। তাদের গ্রেফতার করা গেলে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলাসহ জঙ্গী তৎপরতার নেপথ্যের অনেক অজানা কাহিনী বের হয়ে আসবে যাতে গুলশান হামলার তদন্তের ও সমাপ্তি ঘটাতে সহায়ক হবে। গুলশান হামালার তদন্তে আরও যে পাঁচ সুইসাইড স্কোয়াড সদস্যের নাম এসেছে তার মধ্যে নুরুল ইসলাম মারজান, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী, মোঃ বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট বাশার ওরফে চকোলেট, রিপন ও খালিদ। তারা জঙ্গী হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা জড়িত। এই পাঁচজন গ্রেফতার এড়িয়ে তৎপর থাকায় নব্য জেএমবিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি। তারা যে কোন ধরনের হামলা ও নাশকতা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী নব্য জেএমবির উত্তরবঙ্গের কমান্ডার। গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিল সে। যখন কোন হামলায় দক্ষ সন্ত্রাসীর প্রয়োজন হয়, তখন সে তা সরবরাহ করত। সে গুলশানে দুইজন এবং শোলাকিয়ায় একজন সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিল। এছাড়াও নুরুল ইসলাম মারজান গুলশান হামলায় অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। গুলশান হামলায় অর্থ যোগানের বিষয়ে র‌্যাব ও পুলিশের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, গুলশান হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে ১৪ লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে র‌্যাব জানিয়েছিল, গুলশান হামলাসহ বিভিন্ন হামলার অর্থদাতা ছিল জঙ্গী আব্দুর রহমান। সে র‌্যাবের অভিযানের সময় ছাদ থেকে পড়ে নিহত হয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই এখনও ॥ গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পাঁচ মাস অতিক্রম হলেও জঙ্গী হামলার মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটি) এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম ইউনিট। এ জঙ্গী হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার দেখানো হয়েছে মাত্র দুইজনকে। এরা হলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও কল্যাণপুরে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে আটক রাকিব ওরফে রিগ্যান। এ মামলার তদন্তে প্রায় একশ’ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এদের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া ৩২ জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাদের জবানবন্দী দিয়েছেন। ঘটনা তদন্তে প্রাথমিক পর্যায়ে কাউন্টার টেররিজম ধারণা করে যে, এ হামলার অন্যতম মাস্টার মাইন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডা প্রবাসী তামিম আহমেদ চৌধুরী। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানতে পারেন যে তামিম আহমেদ চৌধুরী হলি আর্টিজানের জঙ্গী হামলায় অপারেশন কামান্ডার হিসেব কাজ করেছে। র‌্যাব বলেছে, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের যোগানদাতা নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এতে দ্বিমত প্রকাশ করায় অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানাই রয়ে গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার একটি অস্ত্র কারখানায় তৈরি করা হয়েছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত পথ দিয়ে ট্রাকে আমের ঝুড়িতে করে অস্ত্রগুলো ঢাকায় আনা হয়। অস্ত্রের বাহক আটক হলেও ঐসব আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে অর্থ কারা দিয়েছে তা শনাক্ত হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের মুখপাত্র ‘দাবিক’ এর একটি সংখ্যায় তামিম আহমেদ চৌধুরী নিজেকে আবু দুজানভ আল-বাঙ্গালী নাম ধারণ করে বাংলাদেশে আইএসের কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা প্রকাশ হয়। তামিম চৌধুরী দুই সহযোগীসহ নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয়। আবার কখনও প্রচারকারী নিজেকে আবু ইউসুফ আল বাঙ্গালী আবার কখনও আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহীম আল-হানিফ, আরেক সাংগঠনিক নাম শাইখ ইব্রাহীম আবু আল হানিফ নামে প্রচার করা হয়, যিনি সাভারের আশুলিয়ায় নিহত হয়েছেন। মূলত তামিমের ওপরে এমন ব্যক্তি রয়েছেন যিনি এ জঙ্গী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। তার পরিচালনা এই কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী এখনও জীবিত। তাকে আমরা খুঁজছি। যদিও সে নিজেকে ‘হানিফ’ নাম বলে প্রচার করছে। কিন্তু সে নব্য জেএমবিতেই আছে, আধ্যাত্মিক নেতা, আত্মগোপনে আছেন।
×