ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সর্বস্ব খুইয়ে অনেকেই দিশাহারা ॥ মাথা গোঁজার ঠাঁই কবে হবে জানে না কেউ

আগুনে পোড়া কড়াইল বস্তিবাসীর রাত কাটছে আকাশের নিচে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

আগুনে পোড়া কড়াইল বস্তিবাসীর রাত কাটছে আকাশের নিচে

আজাদ সুলায়মান ॥ খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটাতে হচ্ছে আগুনে পুড়ে যাওয়া কড়াইল বস্তির পাঁচ শতাধিক পরিবারকে। দিনে দুই বেলা খাবার জুটলেও শীতের রাতে থাকতে হচ্ছে ভস্মীভূত ঘরের উঠানে। কবে নাগাদ তাদের ঘর নির্মাণ করা হবে সেটাও অনিশ্চিত। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতিসহ স্থানীয় অনেকেই শীঘ্রই তাদের ঘর তৈরি করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। রবিবার দুপুরে লাগা আগুনে পাঁচ শতাধিক ঘরের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই ভাড়াটে। অনেকেই সোমবার বস্তি ছেড়ে চলে গেছে। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ভস্মস্তূপের মধ্যে নিজের হারানো মাল খুঁজছেন ষাটোর্ধ মহিলা ছাপিয়া। পোড়া হাঁড়ি-পাতিল, আসবাব, টাকা-পয়সা, জামা-কাপড়ের অবশিষ্টাংশ লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছেন তিনি। ৩-৪টি ভস্মস্তূপের মধ্যে ৩০ মিনিট ধরে খোঁজাখুঁজি করেও কিছুই ফেলেন না। শেষ মুহূর্তে দুই-তৃতীয়াংশ পুড়ে যাওয়া স্টিলের একটি গ্লাস খুঁজে পান এই বৃদ্ধা। গ্লাসটি নিয়ে পোড়া কাঠের ওপর বসেন, শাড়ির আঁচল দিয়ে বার বার চোখ মুছছিলেন। ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে কি খুঁজছিলেন? জানতে চাইলে ছাপিয়া বলেন, বস্তিতে তার ছোট ছোট দশটি ঘর ছিল। একটি ঘরে ছেলে ইব্রাহিমকে নিয়ে থাকতেন। বাকি সব ঘর ভাড়া দিতেন। এতে যেমন-তেমন সংসার চলত। কিন্তু রবিবারের আগুনে তার সবই পুড়ে গেছে। শুধু ঘর নয়; ঘরে থাকা সব কিছুই পুড়ে গেছে। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। পানি খাওয়ার গ্লাসটা পর্যন্ত নাই। তাই ছাইয়ের মধ্যে খুঁজে দেখছেন, কিছু পাওয়া যায় কি-না। কাঁদতে কাঁদতে ছাপিয়া বলেন, বাবারে, বস্তিতে থাকি! সুখ কি জিনিস তা কখনও জানতে পারিনি। তবুও ডাল-ভাত খেয়ে দিন যাচ্ছিল। আমাদের মতো গরিবের ঘরে মূল্যবান কিছু ছিল না, যা পুড়ে গেছে তা আমাদের জন্য মূল্যবান ছিল। এখন তো কিছুই নাই। তাই ছাইয়ের মধ্যে একটি সুতা খুঁজে পেলেও তা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান। হাসান নামে এক ব্যক্তি বলেন, শীতের রাত কেটেছে খোলা আকাশের নিচে। অস্থির ছিলাম কেন সকাল হয় না। সূর্যের আলো দেখার অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছিল না। ভোরের আলো যখনই ফুটতে শুরু করেছে তখন থেকেই খোঁজাখুঁজির কাজ শুরু করি। যদি ছাইয়ের মধ্যেও কিছু পাওয়া যায়। পাশের ছোট্ট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন চা দোকানি লুৎফর রহমান। বস্তির ভেতর দোকানে চা বিক্রি করে সংসার চালান। আগুনে তার দোকানসহ ঘরের সব কিছু পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে কপালে হাত দিয়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন লুৎফর। এখন স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে কোথায় গিয়ে মাথা গোঁজবেন তা ভাবিয়ে তুলছে লুৎফরকে। লুৎফর বলেন, ঘটনার পর থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত সাহায্য সহযোগিতা তো দূরের কথা, সরকার এমনকি কারও কাছ থেকে আশ্বাসটুকুও পাননি। স্থানীয় লোকজন দুই বেলা খিচুড়ি খেতে দিয়েছেন কিন্তু দুঃচিন্তায় খাবার পেটে যাচ্ছে না। পুড়ে যাওয়া বস্তির দুটি ঘরে ভাড়া থাকতেন শাওন ও রফিক নামে দুই যুবক। এদের মধ্যে শাওনের বস্তির ভেতর ভাঙ্গারির ব্যবসা আর রফিক পুরাতন জামা-কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। শাওনের নগদ ১৫ হাজার এবং রফিকের ২৫ হাজার টাকা পুড়ে গেছে। বস্তির একটি পোড়া ঘরের মেঝেতে দেখা যায় কয়েক নারী-পুরুষ বসে আছেন। তাদের একজন কুমিল্লার শ্যামল দাস। রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রী আদর রানী দাস আর ছেলে নির্মল দাসকে নিয়ে শ্যামল খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন সাহায্যের আশায়। তিনি বলেন, লুঙ্গিটাও প্রতিবেশীগো কাছ থেকে ধার কইরা পরছি। দেশে জমি-জিরাত নাই, সরকার কিছু ব্যবস্থা না করলে কই যামু। তার পাশে পঙ্গু এক লোক বসে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তার নাম মন্টু মিয়া; দেশের বাড়ি কুড়িগ্রাম। দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালাতেন। তার অবস্থা বোঝাতে তো ভাষার প্রয়োজন হয় না। তার বাম পাশে দোকান বসিয়ে চা বিক্রি করে পরিবার চালাত বাকপ্রতিবন্ধী বিল্লাল; পাশাপাশি কম্পিউটারে নানা কাজও করত। সেই দোকানেই মাকে নিয়ে থাকত। পোড়া দোকানের সামনে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিল্লাল। কিছু বলতে পারছে না, তবে চোখে সর্বস্ব হারানোর বেদনার ভাষা স্পষ্ট। বিল্লালের মা হাহাকার করে বলছিলেন, গায়ের কাপড় ছাড়া কিছুই বাঁচাইতে পারি নাই গো। দিনে রোদের তাপ-আর রাতে খোলা আকাশের নিচে শীতের কাঁপুনিতে বিপর্যস্ত এসব পরিবার। শিশুরা ছাড়া কারও মুখে হাসি নেই। শূন্য চোখে তাদের সব হারানোর বেদনা। এখনও কিছু মূল্যবান সম্পদ আর গচ্ছিত টাকা খোঁজার অভিযান চলছে। আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া ধ্বংসস্তূপগুলোই এখন বস্তিবাসীর শেষ ভরসা। কোদাল দিয়ে সবাই নিজের ঘর ও দোকানে খুঁড়ে দেখছেন। পুড়ে যাওয়া বস্তির চার পাশে পড়ে আছে ঘরের টিন আর বাঁশ। বস্তিতে হাঁটতে গেলে পায়ে লাগে অসংখ্য তার আর ছাই। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেরা নিজ নিজ ঘরে কোদাল দিয়ে ছাই সরাচ্ছে। মূল্যবান জিনিসগুলো বস্তায় ঢুকাচ্ছে। অনেকে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে মাটিতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছেন। মাথার উপর পর্দা দিয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ বা একেবারে ছেড়ে গেছেন বস্তির মায়া। এদিকে বার বার একই বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ এখানকার বাসিন্দারা। তাদের বদ্ধমূল ধারণাÑ এ আগুন রহস্যজনক। প্রতিবছরই এ বস্তির কোন না কোন জায়গায় অগ্নিকা- ঘটে। ফায়ার সার্ভিস তদন্তও করে। সে তদন্তের রিপোর্ট বস্তির বাসিন্দারা কখনই জানতে পারছে না। বস্তির বাসিন্দা জমির আলী সাংবাদিকদের জানান, লেপ তোশকের দোকানে আগুনের সূত্রপাত হলেও দেখতে হবে এ আগুন কেউ লাগিয়ে দিয়েছে নাকি এটা দুর্ঘটনা। কারণ এ বস্তির ওপর নজর রয়েছে ভূমিদস্যুসহ অনেক প্রভাবশালী মহলের। যদিও এ জমির বর্তমান মালিক সরকারের দুটো প্রতিষ্ঠান টিএন্ডটি ও পূর্ত মন্ত্রণালয়। এছাড়াও জমির আদিবাসী একটা গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে; যাদের ষাটের দশকে উচ্ছেদ করে তৎকালীন ডিআইটি এ জায়গার অধিগ্রহণ করেছিল। ভূমি অধিগ্রহণের পর মূল মালিকরা টাকা-পয়সা বুঝে নিলেও তাদের একটা অংশ এখনও বাস করছে পাশের ওয়্যারলেস গেট এলাকায়। তারাও মাঝে মধ্যে এ জায়গা তাদের পৈত্রিক দাবি করে মহড়া দিয়ে যায়। তাদেরও নজর এ বস্তির প্রতি। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বনানীর এক বাসিন্দা মাজহার জনকণ্ঠকে বলেন, কড়াইল বস্তির সব আগুন যে স্রেফ দুর্ঘটনাÑ এটা আর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এ জমির মালিকানা নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বিরোধ রয়েছে। প্রথম পক্ষ হচ্ছেÑ ষাটের দশকে ডিআইটি অধিগ্রহণের সময় এ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মূল মালিক পক্ষ, দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছেÑ অধিগ্রহণের পর তৎকালীন টিএন্ডটি বিভাগ। পরে টিএন্ডটি বিভাগ এ জমি বিক্রি করে দেয় গণপূর্ত বিভাগের কাছে। তারপর থেকে শুরু হয় বিরোধের সূত্রপাত। তিনি বলেন, টিএন্ডটি বিভাগ গণপূর্তের কাছে বিক্রি করার পর মূল ভূমি মালিকরা এসে প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের কাছেই হয় বিক্রি, না হয় লিজ দেয়ার দাবি জানাতে শুরু করে। যদি অর্ধশতক বছর ধরে ওই জমিতে সরকার কোন স্থাপনাই নির্মাণ করতে পারেনি। এতেই মূল আদিবাসীরা জমির মালিকানা ফিরে ও দখল পেতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বারবার বস্তিতে আগুন লাগার নেপথ্যে এদেরও হাত থাকতে পারে বলে বস্তিবাসীর সন্দেহ। পরশু দিনের অগ্নিকা-ের পর ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পাশে দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব ত্রাণ তৎপরতা চালানোর আশ্বাস দেন। সোমবার ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমত উল্লাহ ও বনানীর কমিশনার মফিজুর রহমানসহ অন্য নেতৃবৃন্দ কড়াইল বস্তিবাসী পরিদর্শনে যান। সেখানে সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন। তারা দ্রুত ঘর তৈরিতেও সহায়তার আশ্বাস দেন। এ আশ্বাসের পর সোমবার আহতদের চিকিৎসা সেবায় ডিএনসিসি’র ২টি চিকিৎসক দলকে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। ডিএনসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সোমবার সকাল থেকে তারা কাজ শুরু করে। অগ্নিকা-ের সময় আগুনে পুড়ে কিংবা ভেঙ্গে পড়া টিনের চাল বা তারকাঁটার আঘাতে আহত হয়েছেন নারী ও শিশুসহ এমন প্রায় ১৫০ জনকে এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যথাযথ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। ডিএনসিসি’র চিকিৎসক দলের সেবা প্রদান কার্যক্রম আজ মঙ্গলবারও চলবে। প্রয়োজনবোধে এ সময়সীমা আরও বাড়ানো হবে। এ সম্পর্কে বস্তিবাসীদের ত্রাণ তৎপরতা তদারকিতে ব্যতিব্যস্ত থাকা বনানী থানা মহিলা আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি হাসিনা পারভীন ও আওয়ামী লীগ নেত্রী সুফিয়া রহমান জানান, দলীয় নির্দেশনাতেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রয়োজনীয় মানবিক সেবা প্রদান ও ত্রাণ বিতরণের কাজ চলছে। বারবার কেন আগুন লাগে এটা রহস্যজনক হলেও এ নিয়ে রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। এখন তাদের পুনর্বাসনের জন্য কমিশনার মফিজুর রহমানের নেতৃত্বে কাজ চলছে। উল্লেখ্য, মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে রবিবার দুুপুরে এ বস্তিতে আগুন লাগে। এতে পুড়ে যায় প্রায় পাঁচ শ’ ঘর। বেলা আড়াইটার পর ওই বস্তিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পৌনে দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর বেলা ৪টা ২০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
×