ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আজ একনেকে উঠছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

আজ একনেকে উঠছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প

আনোয়ার রোজেন ॥ স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল গত শতকের ষাটের দশকে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজও এগিয়েছিল কিছুটা। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এরপর কেবল আলোচনার টেবিলেই ঘুরপাক খেয়েছে রূপপুর। সেই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে। অর্থের অভাব ঘুচিয়ে দেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের সিঁড়িতে তুলেছেন বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনা। অবশেষে এবার পারমাণবিক বিদ্যুতের সেই স্বপ্নও পূরণ হতে চলেছে বাংলাদেশের। একই সঙ্গে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে আরও একধাপ এগোতে যাচ্ছে লাল-সবুজ পতাকা। দীর্ঘ ৫৬ বছর পর আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ (মূল পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদনের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ননের দিন গণনা শুরু হবে। নয় বছর মেয়াদী এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। ২০২৫ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে উৎপাদনে যাবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্রটি। একনেক সভায় অনুমোদন পেলে এটিই হবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প। অর্থের অঙ্কে এক সময় পদ্মা সেতুই ছিল সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প। এর মধ্যে নেয়া অনেক প্রকল্পই পদ্মা সেতুর ব্যয়ের মাইলফলক ডিঙ্গিয়েছে। কিন্তু এবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুক কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প। আজকের সভায় এটিসহ আরও দুটি বৃহৎ প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো ‘ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অপরটি হলো দেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু নির্মাণ বিষয়ক প্রকল্প ‘যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ’, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পে প্রায় ৭ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। সোমবার পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গত ২৬ জুলাই রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মধ্যে প্রায় ১১শ’ কোটি মার্কিন ডলারের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট (ঋণ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা) এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়ার দেয়া ঋণের সুদের হার হচ্ছে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর সঙ্গে লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেট (লাইবর) যুক্ত হবে। তবে তা কোনভাবেই ৪ শতাংশের বেশি হবে না। এছাড়া ঋণ ব্যবহার কাল ৮ বছর, গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর এবং পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বিদ্যুত চাহিদা পূরণে ১৯৬০ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য ১৯৬০ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে কারিগরি, অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি নির্মাণ সম্ভব হয়নি। সরকারের বিদ্যুত খাতের মাস্টারপ্লান অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুত সরবরাহের ১০ শতাংশ পারমাণবিক বিদ্যুত থেকে পাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং গাইডলাইন অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য ২০১০ সালের ২১ মে বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক ও একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি এবং ২০১২ সালের ৪ জুন বাংলাদেশে পারমাণবিক খাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি এ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি ঋণচুক্তি এবং প্রকল্পের মূল কাজ বাস্তবায়নের জন্য একটি সমঝোতা চুক্তি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ (প্রথম পর্যায়) শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এটি ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল একনেকে অনুমোদন লাভ করে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুরে এ বিদ্যুত কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে প্রথম পর্বের কাজ শেষপর্যায়ে রয়েছে। এবার মূল পর্বের কাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষা। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে মূল পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। মূল কাজ সম্পাদনের জন্য রাশিয়ান সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে অর্থায়ন চুক্তি সই হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছেÑ পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ১ ও ২নং ইউনিটের বিস্তারিত ডিজাইন তৈরি, সরঞ্জামাদি সংগ্রহ, এলটিএমই সংগ্রহ, এ দুটি ইউনিট নির্মাণ, পারমাণবিক জ্বালানি সংগ্রহ, কমিশনিং ও টেস্টিং ইত্যাদি করা হবে। এছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ৩৬৯ জন এবং পরমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের অন্যান্য কাজ পরিচালনার জন্য ২ হাজার ৫৩৫ জন জনবল নিয়োগ, প্রকৌশল সরঞ্জামাদি স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ, পূর্ত নির্মাণ কাজসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, আইন অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের হাতে। তবে কেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্ব পাবে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ’। প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে দুটি বিদ্যুত ইউনিটের (ইউনিট ১ ও ২) সমন্বয়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা যাবে। সেই সঙ্গে এটি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো তৈরি, বিদ্যুত কেন্দ্র পরিচালনার জন্য পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
×