ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিচারণে কমান্ডার আবদুর রউফ

‘শহীদ নিজাম ভাইকে হারানোর স্মৃতি আজও যন্ত্রণা দেয়’

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

‘শহীদ নিজাম ভাইকে হারানোর স্মৃতি আজও যন্ত্রণা দেয়’

আরাফাত মুন্না ॥ ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সিলেট ও জকিগঞ্জের মাঝামাঝি কাটালপুর ব্রিজ ভাঙ্গতে গিয়ে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে। ওই যুদ্ধে অনেক পাক আর্মিই প্রাণ হারায়। সেই সঙ্গে আমাদের কমান্ডার খাজা নিজামউদ্দিন ভুইয়াও শহীদ হন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পার হয়ে গেছে, তবে নিজাম ভাইকে হারানোর স্মৃতি আজও যন্ত্রণা দেয়। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন, গ্রুপ কমান্ডার আঃ রউফ মোল্লা। সোমবার জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় তুলে ধরেন তার যুদ্ধ দিনের নানা স্মৃতি। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আউটশাহী গ্রামে জন্ম তার। সেখানেই বড় হয়েছেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর থেকেই তারা যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আউটশাহী রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে তারা ডামি রাইফেল বানিয়ে ট্রেনিংও করেছেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালানোর পর পরই যুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ওই সময় তিনি ইন্টারমিডিয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে জানান। একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আগরতলা হয়ে ভারতের ট্রেনিংকেন্দ্রে জন্য। তিনি জানান, অসমের লোহারবন্ধে প্রথমে এক মাস গেরিলা ট্রেনিং এবং পরে জেএলডব্লিউ (জুনিয়র অব লিডার উইন্স) প্রশিক্ষণও নেন তিনি। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ট্রেনিংয়ের পর আমাকে চার নম্বর সেক্টরের সিলেটের কানাইঘাট থানায় আসতে হয়। সেখানে কয়েকটা যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর জকিগঞ্জ ও সিলেটের মাঝামাঝি কাটালপুর ব্রিজ ভাঙ্গার যুদ্ধ আমার সবচেয়ে স্মরণীয়। সিআর দত্তের নির্দেশে আমরা ওই ব্রিজ ভাঙ্গতে যাই। এই অপারেশনে আমরা ব্রিজ ভাঙ্গতে সক্ষম হলেও আমাদের প্রধান কমান্ডার খাজা নিজামউদ্দিন ভুইয়া (বীর উত্তম) শহীদ হন। আমরা তাকে মোকামটিলায় এক আউলিয়ার কবরের পাশে সমাহিত করি। তিনি ছাড়াও আমাদের আরও দুই-তিনজন সহযোদ্ধা আহত হয় ওই যুদ্ধে। আমার চোখের সামনেই মৃত্যু হয় নিজাম ভাইয়ের। নিজাম ভাইকে হারানো স্মৃতি আমাকে এখনও যন্ত্রণা দেয়। নিজাম ভাই শেরাটন হোটেলে চাকরিরত অবস্থায় যুদ্ধে যান। শেরাটনের শহীদ মিনারের নামফলকে তার নামও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এরপর ২২ সেপ্টেম্বর আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে পাকি বাহিনী। আমি তখন নকতিপাড়া ক্যাম্প কমান্ডার। ঠিক একই সময়ে আমাদের ক্যাম্পসহ সিলেটের নারায়ণপুর, মনতাজগঞ্জসহ একাধিক ক্যাম্পে একযোগে হামলা চালায়। ওই দিন পাকি বাহিনীর তীব্র আক্রমণে আমার সহযোদ্ধা আহম্মদুল্লাহ, শরিফ ও বেলুচী শহীদ হয়। আমারও বাঁচার আশা ছিল না। আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে যাই। এরপর হাওড় বিল পারি দিয়ে কুলিয়ান বিএসএফ ক্যাম্পে আসি। পরে কুলিয়ান থেকে ভারতের জালালপুর, সেখান থেকে মাছিমপুর হয়ে মেলাঘর আসি। তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা মেলাঘর থেকে বিক্রমপুরের উদ্দেশে রওনা হই। আমার নেতৃত্বে টঙ্গীবাড়ি মুন্সীগঞ্জ। জাহাঙ্গীর ও মিজানের নেতৃত্বে লৌহজং। এবং নাসিরের নেতৃত্বে শ্রীনগর। তিনটি গ্রুপে ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা আমরা বিক্রমপুরে আসার পথে কুমিল্লার বাতাকান্দিতে পাক সেনাদের লঞ্চ আক্রমণ করি। সেখানে প্রায় দুই দিনব্যাপী যুদ্ধ হয়। আমরা নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যে কোন একদিন সকাল বেলায় লঞ্চ আক্রমণ করি। পাক সেনাদের লঞ্চ বাতাকান্দি বাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা আক্রমণ করি। এই যুদ্ধে আমরা তিন পাক সেনাকে আমরা জীবিত ধরতে পারি। এর মধ্যে এক জন স্থানীয় জনতার গণধোলাইতে নিহত হয়। বাকি দুজনকে আমরা স্থানীয় কমান্ডার গিয়াসউদ্দিনের কাছে বাকি দুইজনকে হস্তান্তর করি। পরে আমরা দুই নম্বর সেক্টরে বিক্রমপুরে চলে আসি। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিক্রমপুরে আসার পর ১৪ নবেম্বর রাতে আমার গ্রুপ নিয়া শাহজালাল শিকদারের আমন্ত্রণে টঙ্গীবাড়ির উপজেলার চাঙ্গুরি এলাকার দত্ত বাড়িতে যাই। ওইখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত এলো ১৪ নবেম্বর রাতেই টঙ্গীবাড়ি থানায় আক্রমণ করা হবে। আমরা শামসুল হক কমান্ডারকে চিরকুট পাঠিয়ে আসার জন্য বললাম। বর্তমান টঙ্গীবাড়ি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় যেখানে আছে সেখানেই আমার অবস্থান ছিল। রতন তার গ্রুপ নিয়ে উত্তরে, পূর্বদিকে শাহজাহান এবং দক্ষিণের দিকে শামসু’র তার গ্রুপ নিয়ে থাকার কথা ছিল। তিনি বলেন, এখানে আমাদের বেশি সময় যুদ্ধ করতে হয়নি। চারদিক থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ার পরই ইপিআর-পুলিশসহ পাকি বাহিনীর ৩০ থেকে ৩৫ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। ওরা আত্মসমর্পণের পরই আমরা থানায় দখলে নেই। পরে ১৫ নবেম্বর সকালে আমরা জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টঙ্গীবাড়ি থানায় উত্তোলন করি। পরে বিবিসিতে দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত এলাকা হিসেবে টঙ্গীবাড়ি থানার নাম প্রচার করা হয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও জানান, টঙ্গীবাড়ি থানা জয়ের পর ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী আসলেন। আউটশাহী বাজারে মিটিং করে তিনি আমাকে মানিকগঞ্জে নিয়ে যান। সেখানেও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেই। যুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার আঃ রউফ মোল্লা যুদ্ধ শেষে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা একাত্তরে হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে যুদ্ধের কারণে এই পরীক্ষা হয় ’৭২ সালে। পরে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে বিএতে ভর্তি হন। পরে পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবসা শুরু করেন। জাতির এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে জড়িত আছেন নানা সামাজিক কর্মকা-ে। তিনি বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মুন্সীগঞ্জ জেলা কমান্ডে ডেপুটি কমান্ডারে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের সহ-সভাপতি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মুন্সীগঞ্জ জেলা শাখার সহ-সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ মাদ্রাসা উন্নয়ন কাজেও সম্পৃক্ত তিনি।
×