ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব্যসাচী দাশ

ভালবাসায় আধুনিকায়ন

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

ভালবাসায় আধুনিকায়ন

প্রেম-ভালবাসা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ অনুভূতি ছাড়া মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। ভালবাসাহীন জীবন কখনও কখনও আমাদের আত্মঘাতী করে তোলে। ভালবাসা বলতে সব সময় কেবল বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আবেগীয় অনুভূতি বোঝায় না। পারিবারিক বন্ধন পিতা-মাতা, ভাই-বোন কিংবা বন্ধু এদের মধ্যকার স্নেহ-ভালবাসাও জীবনকে পূর্ণ করে। তবে তরুণ বয়স বা যৌবনে পরিবারের বাইরে আমরা এক ধরনের আবেগীয় ভালবাসার অভাব বোধ করি। এই আবেগীয় অভাবটা আমাদের কোন কোন ক্ষেত্রে বড় বেশি শূন্য করে ফেলে। হৃদয় চায় অপরিচিত বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গ পেতে। ভবিষ্যত জীবনের সঙ্গী খুঁজতে রোমানঞ্চকর পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায়। তবে আবেগের বাইরেও এর কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। অর্থাৎ মানবদেহের একাধিক স্নায়ু গ্রন্থি ও বিভিন্ন হরমোন এই আলাদা ভালবাসার পরিচায়ক। যৌবনে আমাদের ভেতর যে ভাব বিনিময়ের অভাববোধ তৈরি হয়, তা কিন্তু জীবনে অন্য কোন অধ্যায়ে অনুভুত হয় না। যৌবন যে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হয়ত এটাও তার একটা কারণ। কাউকে ভালবাসার প্রাথমিক ধাপ হলো তাকে ভাললাগা। কারণ, ভাল না লাগলে ভালবাসা যায় না। মানুষের এই ভাললাগা এবং ভালবাসার ইতিহাস পৌরাণিক ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্ট তত্ত্বের শুরুতে পাওয়া যায়। প্রেম-ভালবাসা যুগে যুগে রং বদলিয়ে নতুন রঙে ধরা দিয়েছে মানব মননে। এ জন্য অসংখ্য কালজয়ী উদাহরণই যথেষ্ট। সভ্যতা এখন আধুনিকতার স্বর্ণ শিখরে। আমাদের সব কিছু এখন অত্যাধুনিক। খুব দ্রুত আমাদের সব কিছু বদলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে তাল না মিলিয়েও। প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে ঘটছেও তাই। উদাহরণ হিসেবে সময়ের কত স্বল্প ব্যবধানে বদলে গেল আমাদের এই প্রেম-ভালবাসার ধরন ও ধারণা। এক্ষেত্রে গেল শতাব্দীর শেষ দশকের কথাই উল্লেখ করা যাক। সেই দশকে কোন ছেলে বা মেয়েকে ভাল লাগলে বা প্রেম নিবেদনে ইচ্ছা জাগলে তার কৌশল ও ভাষা ছিল এখানকার থেকে একেবারেই আলাদা। একটা গল্প বলা যাক, সময়টা ১৯৯২-৯৩ সাল। মফস্বল শহর বাগেরহাট। সাবরিনা আক্তার মৌ । এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাড়ি মূল শহর থেকে একটু দূরে। কোন এক কাজে কলেজ বন্ধের দিন বেরিয়েছে বড় বোন সুমির সঙ্গে। শহরের পাবলিক লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে। ওই এলাকায় একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-ছোকরারা বিকেলে চা খেতে আড্ডা দিতে নিয়মিত ভিড় জমায়। সঙ্গে নাটক, সিনেমা, দেশ- রাজনীতির গল্পবাজিও চলে। মৌ ও সুমি লাইব্রেরি থেকে বেড় হওয়ার সময় রিসিপশনে দেখা হয় শামীমের সঙ্গে। সুমি বেশ পড়ুয়া ছাত্রী। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ। সরকারী পি. সি. কলেজ। এ্যাকাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে বাংলা সাহিত্য তার মনের খোরাক। অন্যদিকে শামীম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অনার্স চতুর্থ বর্ষ। বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। সে সুবাদে শামীম প্রায়ই লাইব্রেরি পড়াশোনা করত। খুলনার সঙ্গে দূরত্ব কম সময়ের হওয়ায় বাগেরহাট থেকেই যাওয়া-আসা করত। শহর ছোট হওয়ায় বেশিরভাগই একে অন্যের পরিচিতি। যে কারণে শামীম মোটামুটি সবার মুখ চেনেন। বিশেষ করে যাদের নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসা-যাওয়া। সঙ্গত কারণে সুমির সঙ্গে শামীমের প্রায়ই দেখা হতো। চোখে চোখও পড়ত। তবে সবটাই ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য বিপত্তি ছিল। যখন সুমির সঙ্গে তার ছোট বোন মৌ থাকত। তাকে দেখলে মনের ভেতর এক অজানা চঞ্চলতা শামীম অনুভব করত। মৌ অবশ্য অল্প দিন নিয়মিত সুমির সঙ্গে লাইব্রেরীতে। কয়েক সপ্তাহ বাদে তার এ চঞ্চলতা কমল ভাললাগায় রূপ নিল। শেষে এমন হলো সুমিকে দেখলেই তার চোখ চঞ্চল হয়ে সামনে-পেছনে ছোটাছুটি করত। মন তার আনমোনা হতো যেই তার দেখা পেত। শামীম যেহেতু সাহিত্যের ছাত্র সেহেতু প্রেম ও ব্যক্তিত্ব তাঁর সমসম। বড় বোনের সামনে ছোট বোনকে কোন ইঙ্গিত একেবারেই তার রুচিবহির্ভূত। দিন-মাস চলে যায়। সান্ত¡না কেবল দীর্ঘ চোখের পলক। কিন্তু মনের ভেতর তার দোল খাওয়া কোমল ঘাসগুলোতে আর বুনোফুল ফোটে না। এক সময় থেমে যায় দোল খাওয়া ঘাস। স্থির হয় পুলক। শামীম পাস করে ব্যস্ত হয়ে যায় ক্যারিয়ার নিয়ে। মাত্র ষোলো-সতেরো বছরের ব্যবধানে এই ভাললাগা বা প্রেম নিবেদনের পুরো চিত্র বদলে যায়। প্রেমের ক্ষেত্রে আধুনিকতার নামে ছেলেমেয়ে উভয়ই হয়ে গেল এক রকম বেপরোয়া। বেশীর ভাগই আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ঢুকে পড়ল বিজ্ঞানের অপব্যবহারে। এই কমল অরণ্যে। এক্ষেত্রে ছেলেরা হয়ে উঠল অনেকটা এগ্রেসিভ। বয়স কিংবা বোধের বিচার হলো তাদের কাছে অবিচার। পছন্দ কারা মানুষটির বাবা, মা, বড় ভাই কিংবা বড় বোন তাদের শ্রদ্ধা তো দূরের কথা ন্যূনতম সম্মানটুকু ও এখন আর জোটে না। কখনও কখনও ভীষণ বিব্রত হতে হয় এখনকার নবীন প্রেমিকদের আচরণে। যেটা অদূর অতীতে একেবারেই ছিল না । ইন্টারনেট স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটারÑ এসব এখন প্রেম নিবেদনের সরঞ্জাম। এক কথায় প্রেম-ভালবাসা এখন ডিজিটালাইজড। তাই বলে এসবের বিরুদ্ধে বলছি না। বলতে চাই কেবল প্রেমের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের অপব্যবহার নিয়ে। বিষয়টি অতো সস্তা নয়। কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের কী চাপার মতো। প্রেম নিবেদনের শুদ্ধ চিন্তার ইতিহাস সুদীর্ঘ। আর চঞ্চলমতির প্রেমের ইতিহাস কেবলই সমসাময়িক। ফলাফল প্রতিনিয়ত চোখের সামনে বর্তমান। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রহসন চলছে। প্রেম- ভালবাসার নামে। তাই বলে সব কিছু তো আর একেবারে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সুচিত্তে স্থির হওয়া সম্ভব। শুভ বোধ ধারণ করা সম্ভব। নয়ত হারিয়ে যাবে ভালবাসার মাধুর্য। দূষিত হবে পবিত্র প্রেম শব্দটি।
×