ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এশীয় চারুকলার আকর্ষণ স্থাপনা শিল্প

বিপুল পরিসরে বহুবিধ বলা, সমকালীন চিন্তার বাতাবরণ

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

বিপুল পরিসরে বহুবিধ বলা, সমকালীন চিন্তার বাতাবরণ

মোরসালিন মিজান ॥ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর বিপুল আয়োজন। সমৃদ্ধ ভা-ার। দেশের সবচেয়ে বড় আসরে স্থানীয় শিল্পীরা যথারীতি অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। একই গ্যালারিতে সমাকালীন ভাবনার বিস্তার ঘটিয়েছেন বিদেশী শিল্পীরা। বহুবিধ মাধ্যমে গড়া শিল্পকর্ম দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে আর সব মাধ্যম থেকে একটু আলাদা ইনস্টলেশন আর্ট বা স্থাপনা শিল্প। বড় জায়গা নিয়ে শিল্পীরা তাদের চিন্তাকে সাজিয়েছেন। ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা মুগ্ধ করে রেখেছে শিল্পপ্রেমীদের। সাধারণ দর্শকও খুব সহজে আকৃষ্ট হচ্ছেন। স্থাপনা শিল্পের ভাষাটি পড়ার চেষ্টা করছেন তারা। এভাবে এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য দিক হয়ে উঠেছে ইনস্টলেশন আর্ট। জাতীয় চিত্রশালার একাধিক গ্যালারিতে এই ধারার শিল্পকর্ম। অধিকাংশ সময় শূন্য পড়ে থাকা জায়গাগুলো শিল্পীরা ভরিয়ে দিয়েছেন। প্রদর্শনীতে মোট স্থাপনা শিল্প রয়েছে ২০টি। দ্বিতীয় তলার খোলা জায়গায় অপেক্ষাকৃত বড় জায়গা। এখানে কাছাকাছি দূরত্বে অনেকগুলো ইনস্টলেশন আর্ট। মিক্সড মিডিয়ায় মনের কথা ব্যক্ত করেছেন শিল্পীরা। অন্যতম একটির শিরোনাম ‘দি রেস্টলেস ওয়েভ অব টাইম।’ শিল্পী হারুন-অর-রশীদ টুটুল। আজকের অস্থির সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। কালো কাপড়ে মোড়ানো একটি কক্ষের ভেতর মূল উপস্থাপনা। ভাস্কর্য লাইট এবং সাউন্ডের ব্যবহারে চমৎকার শিল্পভাষা নির্মাণ করেছেন শিল্পী। তার স্থাপনায় মানুষের হরদম ছোটাছুটি। স্বপ্ন ছুটছে। বসে নেই দুঃস্বপ্নেরা। চলছে ঠুকাঠুকি। চারপাশে কত শত ঘটনা। ঘটনার ঘনঘটা। দুর্ঘটনারও শেষ নেই। মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ, মানবিকতার বিপর্যয়Ñ সব খুব দ্রুত ঘটছে। চোখের সামনে। এমন অস্থিরতা এবং বিপর্যয়ের কেন্দ্রে থেকেও অনেকে তা উপলব্ধি করেন না। শিল্পী সেই উপলব্ধিটুকু দেয়ার চেষ্টা করেন। এই কাজটি জুরি বোর্ডেরও পছন্দ হয়েছে। তাই গ্র্যান্ড প্রাইজ জিতেছেন টুটুল। তৃতীয় তলায় প্রবেশ করার মুহূর্তে চোখে পড়ে ‘মা, আমার মা’ স্থাপনাটি। উত্তম কুমার রায়ের কাজ। শিরোনামই বলে তার বিষয়Ñ মা। দেয়াল এবং মেঝে ব্যবহার করে নিজের শিল্পকর্ম গড়েছেন তিনি। দেয়ালে বিশাল প্রতিকৃতি। হ্যাঁ, মায়ের মুখ। শিল্পী নিজের মায়ের মুখ ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করেছেন ২ হাজার ১০০ মা ও সন্তানের মুখ! কোলাজটির কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়। বিভিন্ন জাত পাত ধর্ম বর্ণের নারী। কিন্তু যখন মা তখন আর সব বিবেচনায় আসে না। মায়ের কোন জাত নেই। ধর্ম নেই। তিনি মা। এই একটি জায়গায় এসে সব মা এক। পরস্পরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান। মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে সম্পর্ক তারও স্বরূপ তুলে ধরেন শিল্পী। মা ছাড়া সন্তানের মুখগুলোকে কত বিবর্ণ, শিল্পী এঁকে দেখান। কামরুজ্জামান স্বাধীনের স্থাপনা শিল্পটিও খুব নজর কাড়ে। নিজের কথা বলতে অজস্র ইঁদুর তৈরি করেছেন তিনি। এত এত ইঁদুর। হঠাৎ দেখলে গা কেমন করে উঠে। চোখ স্থির হয়ে যায়। ইঁদুরগুলো খাই খাই স্বভাব নিয়ে ছুটছে শুধু। যা পাচ্ছে, গুগ্রাসে গিলছে। প্রতীকী এ উপস্থানায় শিল্পী যেন বলতে চান, মানুষও নিজের প্রয়োজনে সব গিলে খাচ্ছে। প্রকৃতি পরিবেশ বন সমুদ্র প্রাণী সব ধ্বংস করছে। এমনকি মানুষ তার স্বজাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এমন স্বার্থপর মানসিকতার পরিণতি বলে দেয় ইনস্টলেশন আর্ট ‘গ্রিড।’ এ কাজটিও জিতে নিয়েছে গ্র্যান্ড প্রাইজ। মিক্সড মিডিয়ায় রাজিব কুমার রায় দেখিয়েছেন ‘গ্লোবালাইজেশন অব পলিটিক্স- পলিটিক্স অব গ্লোবালাইজেশন।’ নিজের কথাটি বলতে বায়স্কোপের চোখে তাকিয়েছেন তিনি। দেখেছেন বিশ্বায়নের প্রভাব। প্রদর্শনীতে বিদেশী শিল্পীদের ৯টির মতো স্থাপনা শিল্প। জাপানের ২টি, চিনের ২টি, ইতালীর ১টি, কাতারের ১টি, আর্জেন্টিনার ১টি, ওমানের ১টি এবং চিলির ১টি স্থাপনা। গ্র্যান্ড প্রাইজ জিতেছেন চিলির শিল্পী ডগমরো আনা ওয়াইসকিয়েল। ‘জয়েন্ট গেম’ শিরোনামে ২১ মিনিটের ভিডিও ইনস্টলেশন আগ্রহ নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। এভাবে এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে স্থাপনা শিল্প বিশিষ্টার্থক উপস্থাপনা পেয়েছে। সব শ্রেণীর দর্শক কৌতূহল নিয়ে দেখছেন। পাঠ করার চেষ্টা করছেন শিল্পের পরিভাষা। প্রদর্শনী ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত চলবে।
×