ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ হলো পর্যটন বর্ষ নীরবেই

অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত সেই তিমিরেই ॥ স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও শিল্পরূপ পায়নি

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত সেই তিমিরেই ॥ স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও  শিল্পরূপ পায়নি

হাসান নাসির ॥ অনেকটা নীরবেই শেষ হয়ে গেল সরকার ঘোষিত ‘পর্যটন বর্ষ।’ কিন্তু অপার সম্ভাবনার এ খাত বলতে গেলে রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। যেটুকু বিকাশ তার নেপথ্যে প্রায় পুরোটাই বেসরকারী খাত এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার। একমাত্র ঘোষণা দেয়া ছাড়া সরকারী পর্যায়ে কতটুকু কাজ হয়েছে তার মূল্যায়ন হতেই পারে। পৃথিবীর অনেক দেশই শুধু পর্যটনের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দেশও রয়েছে, যে দেশে অর্থনীতির প্রধান খাতই পর্যটন। অথচ সাগর-পাহাড়-(৪ পৃষ্ঠা ৩ কঃ দেখুন) পার সম্ভাবনার (প্রথম পৃষ্ঠার পর) অরণ্য, লেক-ঝর্ণা-জলপ্রপাত এবং ধান-নদী-খালের এ বাংলায় পর্যটন এখনও শিল্প হিসেবে দাঁড়াতেই পারল না। মন্ত্রণালয়ের নাম ‘বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।’ আরেকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘ও পর্যটন মন্ত্রণালয়’ কেন? এতেই বোঝা যায় কতটা গুরুত্বহীন এ দেশের পর্যটন খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন যেখানে যুক্ত হয়ে আছে আরেকটি মন্ত্রণালয়ের লেজুড় হিসেবে, সেখানে এর চেয়ে বেশি তো আশা করা যায় না। সরকারের উচিত রেলকে গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই পর্যটনকে আলাদা করে বিশেষভাবে জোর দেয়া। কারণ, পর্যটন একটি বিশাল খাত। এ খাতে লাখ লাখ কর্মসংস্থান এবং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। তাছাড়া এটি একটি স্মার্ট খাত হিসেবে বিবেচিত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া শিক্ষিত ছেলেদের আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হতে পারে এই পর্যটন। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব না দেয়ায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় এ খাত স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও শিল্পরূপ পায়নি। কক্সবাজারে বিচ কার্নিভালের মাধ্যমে পর্যটন বর্ষের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। এর আগে ২০১৪ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকায় দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও পর্যটন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী ২০১৬ সাল পর্যটন বর্ষ। বছরটি শেষ হয়ে গেল বড় ধরনের কোন অর্জন ছাড়াই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঘোষিত পর্যটন বর্ষের কার্যক্রম চলবে তিন বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে হিসাবে আরও দুটি বছর সময় রয়েছে। সরকারের টার্গেট এই তিন বছরে অন্তত ১০ লাখ বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো- কত সংখ্যক পর্যটক আসছে, পর্যটক সংখ্যা বাড়ছে না কমছে সেই পরিসংখ্যান পাওয়াটাও দুষ্কর। কারণ, এর জন্য নেই ট্যুরিস্ট স্যাটেলাইট এ্যাকাউন্ট (টিএসএ)। পর্যটন কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের ওয়েব পেজেও কিছু বাণী আর বিজ্ঞপ্তি ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু নেই, যা দিয়ে দেশের পর্যটনের সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ খাতের উন্নয়নের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন নেই। কারণ দেশে দেশে পর্যটন খাতে সবচেয়ে বেশি অবদান প্রাইভেট সেক্টরের। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু প্রয়োজন কানেক্টিভিটি সৃষ্টি, প্রচার ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও দেখা যায় দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে তৈরি করা বিজ্ঞাপন, যেগুলো পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন, ত্রিপুরা পর্যটন, মেঘালয় পর্যটনসহ বিভিন্ন রাজ্য পর্যটন সংস্থার নামে প্রচারিত হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের টিভিগুলোতে নেই তেমন প্রচার। অন্তত পর্যটন বর্ষে সেই উদ্যোগটা নেয়া হবে তেমন আশা করা হলেও তা হয়নি। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে একজন পর্যটক কোন দেশে যাবার পূর্বে গুগলে সার্চ দিয়ে সে দেশের পর্যটন স্পট সম্পর্কে ধারণা নিয়ে থাকেন। পর্যটনের দেশগুলো তাদের দেশের স্পটগুলো নিয়ে কয়েক মিনিটে ডকুমেন্টারি তৈরি করে নেটে ছেড়ে দেয়, যা দেখে বিদেশীরা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তেমন উদ্যোগও উল্লেখ করবার মতো নয়। বগুড়ার মহাস্থান গড়কে সার্ক কালচারাল রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সাবরাংয়ে হবে এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোন। এগুলো ভাল উদ্যোগ, যদিও বাস্তবায়ন সময় সাপেক্ষ। কিন্তু আগে থেকেই বিদ্যমান স্পটগুলোতে যাওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। দিন যতই যাচ্ছে আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। তরুণরা রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সকল দুর্গম স্থানে গিয়ে ছবি আপলোড দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য এ সকল স্থানে গমন সহজসাধ্য নয়। বিদেশী আকর্ষণের পূর্বশর্ত হলো প্রথমে নিজ দেশে পর্যটনকে জনপ্রিয় করা। এর জন্য যেটুকু উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন তা লক্ষণীয় নয়। দেশে পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য চট্টগ্রাম। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, লেক শহর রাঙ্গামাটি এবং নীলগিরি ও নীলাচলখ্যাত সুউচ্চ পাহাড়ের দৃষ্টিনন্দন বান্দরবান যেতে হয় চট্টগ্রাম হয়ে। তাছাড়া শহরের পাশেই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু বছরের শুরুতে চেম্বারের প্রচেষ্টা দেখা গেলেও সংস্থাটি এখন অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্তাব্যক্তি বলেন, আমরা হতাশ না হলেও আশাহত বলতে পারেন। নৌপরিবহন, বিদ্যুত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য এমএ লতিফ এমপি এ প্রসঙ্গে বলেন, এ দেশের সৌন্দর্যের টানে শত শত বছর আগে অনেক পর্যটক এসেছেন, যা আমরা ইতিহাসে পাই। কিন্তু অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে পর্যটন খাত দাঁড়াতেই পারেনি, এটি দুঃখজনক। তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বিশাল ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যাতায়াত সুবিধা, ব্যাপক প্রচার ও নিরাপত্তা। এই তিন উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথ একটি স্পট জনপ্রিয় হয়ে গেলে সেখানে অনেক ব্যক্তি উদ্যোগ এমনিতেই চলে আসে। পর্যটকদের জন্য ফাইভ স্টার হোটেলের প্রয়োজন, তাও নয়। কারণ মানুষ সাধারণত ভ্রমণে বিলাসিতা এবং বাড়তি ব্যয় কাটছাঁট করতে চায়। প্রয়োজন শুধু পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে ঐকান্তিকতা। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এত টিভি চ্যানেল, কিন্তু প্রকৃতি ও পর্যটন বিষয়ক কোন চ্যানেল হলো না। অথচ দেশের যে সৌন্দর্য তা ধারণ এবং প্রচার করেই ডিসকভারির মতো একটি চ্যানেল চালানো সম্ভব। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আলোকে সরকার বেসরকারী উদ্যোগকে বেসরকারী করলেই পর্যটন খাত শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে বলে অভিমত এই সংসদ সদস্যের। চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হতে পারে পর্যটন। কারণ এর সঙ্গে হোটেল-মোটেল, পরিবহন, বিপণি কেন্দ্রসহ অনেক কিছুই সংশ্লিষ্ট। এ খাতের উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান যেমন হয়, তেমনিভাবে দেশের সৌন্দর্যও বাড়ে। চেম্বারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শতবর্ষ পূর্তি উৎসব এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার উদ্বোধন উপলক্ষে আমরা লেক শহর রাঙ্গামাটিতে করেছিলাম ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিজম সামিট। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের বিদেশী কূটনৈতিক এবং অতিথিদের। তারা রাঙ্গামাটি থেকে বিমোচিত হন। এক বাক্যে বললেন, এ সৌন্দর্য সুইজারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। জায়গা পেলে রাঙ্গামাটিতে চেম্বারের উদ্যোগে একটি রিসোর্টও করতে চাই। শুধু আমরা নই, আরও অনেকে আছন যারা পর্যটন শিল্পে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী; কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন সরকারের পদক্ষেপ। বাংলাদেশ খুবই সুন্দর একটি দেশ। এ দেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি জনপদ রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের জাফলং-মাধবকু--বিছানাকান্দি, ধান-নদীর বরিশাল এবং অনেক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। সম্প্রতি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মীরসরাই। এ উপজেলায় অবস্থিত খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। রয়েছে মহামায়া লেক, নাপিত্যাছড়া ঝর্ণা ও মুহুরী প্রজেক্ট। এর মধ্যে পাহাড়ি স্পটগুলোতে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যে ঝর্ণা দর্শনে গিয়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে দর্শনীয় অনেক স্থান। পর্যটন বর্ষের কার্যক্রম চলবে আরও দুই বছর। এ সময়ের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করছে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা।
×