ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি রফিকুলের

‘দুই সেরা রাজাকারকে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে হত্যা করি’

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

‘দুই সেরা রাজাকারকে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে হত্যা করি’

এমদাদুল হক তুহিন ॥ তরুণ প্রজন্মের কাছে এলাকায় তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একাধিক নাটক। সেসব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে গফরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর কাছে তথ্য আদান-প্রদানই ছিল তার মূল কাজ। গফরগাঁও মুক্ত দিবসে রাজাকার হত্যা করে মেতে উঠেছিলেন উল্লাসে। তবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম ওঠাতে গিয়ে ’৯০’র দশকে তিনি হয়েছেন ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার! খোদ আওয়ামী লীগে গফরগাঁওয়ে ছিল তখন দুটি গ্রুপ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় তার নাম। থেমে থাকেননি। পরবর্তীতেও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। নতুন করে নাম অন্তর্ভুক্তির যে সুযোগ রয়েছে সেই যাছাই-বাছাই কমিটিতে এখনও ঝুলে আছে তার নাম! স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় তিনি এখন হতাশ। বিপর্যস্ত! মহান বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খোঁজ মিলে মুক্তিবাহিনীর কাছে তথ্য সরবরাহকারী রফিকুল ইসলামের। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে তার কণ্ঠে ছিল অভিমানের সুর। না পাওয়ার বেদনা। স্বাধীন জীবন যাপন করতে গিয়ে পেশা হিসেবে কখনই বেছে নেননি চাকরি। হেঁটেছেন উল্টোপথে। বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ, তবু তার কলম থেকে থাকেনি। লিখে চলছেন সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে। গফরগাঁওয়ের কুকশাইর গ্রামে জন্ম নেয়া মুক্তি বাহিনীর এই সহায়তাকারী এখনও টিউশনি করে বেড়াচ্ছেন। এলাকায় পরিচিত আব্রাহাম মাস্টার নামে। জানালেন, এলাকার ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন সেই ’৭৫ সাল থেকে। তা দিয়েই চলছে জীবন। চলে যাওয়ার মতো। শেষ বয়সে এসে তার ভাষ্য, ‘মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে মরেও শান্তি পেতাম!’ মুক্তিবাহিনীর কাছে ঠিক কোন্ ধরœর তথ্য আদা-প্রদান করতেন, এমন প্রশ্নে গফরগাঁওয়ের এই আব্রাহাম মাস্টার বলেন, যুদ্ধের সময় আমি প্রতিদিন গফরগাঁও যেতাম। সেখানে পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল। মশাখালীতে ছিল পাকবাহিনীর ক্যাম্প। আর মুক্তিবাহিনীর মূল ক্যাম্প ছিল দত্তেরবাজারে। শাখা ছিল টাঙ্গাবরে। গফরগাঁও থেকে দত্তেরবাজারের দূরত্ব ১৫ কিমি। আর্মিদের গতিবিধি লক্ষ্য করতাম। গফরগাঁও থেকে বের হয়ে তারা কোন্দিকে যাচ্ছে, কখন-কোথায়-কোন্ বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে, কোথায় নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে, সেই খবর দত্তেরবাজার ক্যাম্পে পৌঁছে দিতাম। তথ্যগুলো আমি সরাসরি ১১ নং সেক্টরের কোম্পানি নং ১০’র কমান্ডার ইকবাল-ই-আলম কামালের কাছে পৌঁছে দিতাম। তখনকার যাতায়াত ব্যবস্থার চিত্র উল্লেখ করে তথ্য সরবরাহকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, তখন তো মোবাইল বা যানবাহনও ছিল না। বড় বড় রাস্তায় গরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। টুকটাক দেখা মিলত রিক্সা। প্রতিদিন আমি ১৫ কিমি হেঁটে ইকবাল ভাইয়ের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতাম। তার সেই তথ্য মোতাবেক মুক্তিবাহিনী সতর্ক হতো। অবস্থান নিত। ঝাঁপিয়ে পড়ত যুদ্ধে। আপনার দেয়া তথ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনী কিভাবে উপকৃত হয়েছে বা সরাসরি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করুন। বলতে শুরু করলেন তিনি। তার কথা ‘তখন খুব সম্ভবত ডিসেম্বর। খুব সকালে মশাখালী রেলস্টেশনে যাই। হঠাৎ দেখলাম একটা ট্রেন এসে থামল। সাধারণত এমন সময় ট্রেন আসার কথা না। ট্রেনে খুব সম্ভবত তিনটি বগি ছিল। সবগুলোতেই আর্মি। তাদের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। আমি দূর থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলি। পাকসেনারা মশাখালী নামামাত্রই সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। দোকানপাট বন্ধ করে সবাই বাড়ির দিকে যেতে লাগল। দেখা গেল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আর্মিরা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুতি নিল। তারা ধীরে ধীরে গরুরগাড়িতে উঠছে। মশাখালী স্টেশন থেকে পূর্বদিকে রওনা হলো। রাস্তার আশপাশের মানুষ বাড়ি ছেড়ে সামনের দিকে এগুতে লাগল। সবাই বলতে লাগল ‘পাকবাহিনী আইছে! দৌড়া!’ ঘর থেকে যে যা পেরেছে তাই নিয়ে পালাল। আবার কেউ কিছু ছাড়াই। তিনি বলে যাচ্ছেন। একদমে বললেন। তার ভাষ্য, ‘যখন দেখতে পেলাম আর্মিরা মাইজবাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন ভাবলাম আজ নিশ্চয় দত্তেরবাজারের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করবে। পূর্বে এত আর্মি আমি কখনই দেখিনি। দৌড়ে চলে গেলাম। ফাঁড়ি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকলাম দ্রুত। যে কোন মূল্যে মুক্তিভাইদের রক্ষা করতে হবে। লক্ষ্য একটাই- তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। গিয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম ক্যাম্পে। ইকবাল ভাইকে জানালাম। মুক্তিবাহিনীকে তিনি প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন। আদেশ পাওয়ামাত্রই মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িগাঁও এলাকার সিমাখালী খালে অবস্থান নিল।’ ঘণ্টাখানেক পরের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি অন্য গ্রাম হয়ে আবার আমার এলাকায় চলে এলাম। এক ঘণ্টা পরেই দেখা গেল কন্নাম-ল-কাচারিবাজার এলাকায় ব্রাশফায়ার দিচ্ছে পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করল। এখানে ধানক্ষেতে ৩ মুক্তিযোদ্ধ মারা গেল। পাক কমান্ডারসহ ১২ থেকে ১৩ সেনা নিহত হলো। সাধারণ মানুষ মারা গেল। ৫ থেকে ৭ জন। তারা একই পরিবারের। তবে কোন্ বাড়ির তা ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, যে বাড়িতে হামলা হয় সেখানে অন্তত ৩ নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। সে এক করুণ দৃশ্য। ভয়াবহ। বীভৎস। গফরগাঁওয়ের ইতিহাসে সেই ছিল এক স্মরণকালে ভয়াবহ যুদ্ধ। যদি ঠিক সময়ে তথ্য পৌঁছে দিতে না পারতামÑ তাহলে হয়ত আমাদের আরও মুক্তিভাই মারা যেত। তছনছ হয়ে যেত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।’ রাজাকার হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে আব্রাহাম মাস্টার বলেন, ৯ ডিসেম্বর গফরগাঁও মুক্ত হলো। সে সময় আমি পাকিস্তানের তৎকালীন এক বড় পার্টির গফরগাঁও শাখার প্রধান নেতা ঈশা খা রাজাকারকে হত্যা করি। আমার নিজ গ্রামের শামসুদ্দিন রাজকারকেও আমি হত্যা করি। এলাকার সবাই তখন আমাকে বাহবা দিয়েছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাজাকার হত্যার জন্য যদি আমার ফাঁসি হয়, সে শাস্তিও আমি মাথা পেতে নেব। তবু প্রকাশ্যে বলব, বুক ফুলিয়ে বলবÑ আমি নিজ হাতে রাজাকারকে হত্যা করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছি। তার দেয়া তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে কথা হয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। পাওয়া যায় সত্যতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় জড়িয়ে ছিলেন গভীরভাবে। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে গফরগাঁওয়ের প্রবীণ সাংবাদিক ও কান্দিপাড়া আব্দুর রহমান ডিগ্রী কলেজের উপাধ্যক্ষ শফিকুল কাদির জনকণ্ঠকে বলেন, আব্রাহাম ভাতাপ্রাপ্ত কার্ডধারী মুক্তিযোদ্ধা নয়। তবে সে যুদ্ধের সময় দৌড়ঝাঁপ করত। এলাকার এক রাজাকার হত্যার সঙ্গে সে সম্পৃক্ত ছিল। সে মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিয়ে সহায়তাকারীর ভূমিকায় কাজ করে। একই রকম তথ্য জানান বাঘবাড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবি সিদ্দিক। আর কুকশাইর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ছাইদুর রহমান বলেন, সে খবর আনা-নেয়া করত। আকার-আকৃতিতে ছোট ছিল। বয়সও কম ছিল। ফলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্শ¦বর্তী মাইজবাড়ি গ্রামের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও পঞ্চান্ন বছর বয়সের এক বাসিন্দা জানান, যুদ্ধের সময় রফিকুল ইসলাম (আব্রাহাম) প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। সে তার গ্রামের এক রাজাকার ও তৎকালীন সময়ের কুখ্যাত এক পাকি নেতাকে হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় সে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। একই গ্রামের তরুণ মাহাবুবুল আলম মিথুন বলেন, আব্রাহাম স্যারকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই জানি। তার লেখা নাটক এলাকার তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা চাই যুদ্ধের সময়ে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা দ্রুত সময়ে মূল্যায়িত হোক। দ্রুত সময়ে তাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এলাকায় নাট্যকার হিসেবে পরিচিত মুক্তিবাহিনীর সহায়তাকারী রফিকুল ইসলাম যুদ্ধ চলাকালীন লিখিছেন দুটি পথনাটক। এগুলো হলো ‘রক্ত দিয়েই কিনবো স্বাধীনতা’ ও ‘আমি দাদার এলএমজি ম্যান’। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এই দুটি লেখার ওপর কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল-ই-আলম কামাল আমাকে সার্টিফায়েড করে। আমি যে ভূমিকা রেখেছি, তা তিনি উল্লেখ করেন। সবশেষের প্রশ্ন ছিল এখন কেমন আছেন, এত বছর পর আছেন কেমন। উত্তর এলো ভাল নেই। বললেন, স্ট্রোক করেছি দুবার। প্যারালাইজড হয়েছিল। এই কিছুদিন যাবৎ একটু চলাফেরা করতে পারছি। আক্ষেপের সঙ্গে তার শেষ উচ্চারণ, জীবনের শেষ লগ্নে এসে অন্তত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের স্বীকৃতি পেলে মরেও শান্তি পেতাম।
×