ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই স্কুলে স্কুলে পৌঁছাবে বিনামূল্যের বই ॥ শিক্ষামন্ত্রী

এবারও বছরের প্রথম দিনই দেশব্যাপী পাঠ্যবই উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

এবারও বছরের প্রথম দিনই দেশব্যাপী পাঠ্যবই উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের উপজেলা পর্যন্ত ৮০ ভাগ বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবই ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই শতভাগ পাঠ্যবই সারাদেশের স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এবার প্রথমবারের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতেও বিনামূল্যের বই তুলে দেবে সরকার। এছাড়া প্রথমবারের মতো পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় বই দেয়া হচ্ছে। প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ওরাও ও গারো জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রস্তুত হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ। রবিবার রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় পাঠ্যবইয়ের ছাপাখানা পরিদর্শনে এসে এসব তথ্য জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এবারও বছরের প্রথম দিন দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উৎসব পালন করবে সরকার। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইন, অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা, সদস্য অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী প্রমুখ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা এবার ব্রেইল বই দেব। ইতোমধ্যে ওই বই ছাপানো হয়েছে। তবে সকল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই বই পাবেন সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। কারণ (দৃষ্টিপ্রতিন্ধীদের) তথ্যটা পেতেই আমাদের বিরাট সমস্যা, আমরা জরিপ করছি। এবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য পাঁচটি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের বই ছাপানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর সকল ভাষায় লিপি নেই, সাহিত্য নেই, লেখা নেই। যেটা আছে আমরা চাই সেটাতেই তারা শিখুক। মায়ের কোল থেকে নেমেই সে প্রথমে স্কুলে যায়, বাংলা ভাষায় কথা সে বুঝতে পারে না। ঠিক সময়ে তাদের হাতে এসব বই পৌঁছে দেব। আমরা প্রাথমিক স্তরে সেই ধরনের শিক্ষকও তৈরি করতে চাই। পরিদর্শনকালে শিক্ষামন্ত্রী বিনামূল্যের পাঠ্যবই তৈরি হয়Ñ এমন তিনটি ছাপাখানা পরিদর্শন করেন। ছাপাখানাগুলো হলোÑ আনন্দ প্রিন্টার্স, ব্রাইট প্রিন্টার্স এবং মৌসুমী প্রিন্টার্স। এ সময় মন্ত্রী ছাপাখানায় প্রিন্ট হওয়া বইয়ের কাগজের মান দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, বইয়ে ব্যবহৃত কাগজগুলো টেস্ট করে প্রেসে এনে রাখা হয়েছে। এর বাইরে কোন কাগজ ব্যবহার করতে যেন না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগে ছোট ছোট প্রেসে বই ছাপা হতে। বর্তমানে বিপুল পরিমাণ বই ছাপার কারণে বড় ধরনের ছাপাখানা গড়ে উঠেছে। ৩ বছর আগেও এত বড় আকারের প্রেস ছিল না। পাঠ্যপুস্তক ছাপাকে কেন্দ্র করে এ শিল্পের বিকাশ হয়েছে। বড় আকারের প্রেস স্থাপন করা হয়েছে। এ শিল্পে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে উন্নতমানের অটোমেটিক মেশিনে ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। সারাদেশে পাঠ্যবই বিতরণ কাজের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সব বই পৌঁছে যাবে। গতবারের চেয়ে এবার প্রায় তিন কোটি বই বেশি দেয়া হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে প্রতিবছরই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝরে পড়া কমছে। যার ফলে প্রতিবছরই বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। গতবছর বই বিতরণ করা হয়েছিল ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার ৯৭২টি। এবার বিতরণ করা হবে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সঙ্গে চুক্তি থাকায় প্রাথমিক স্তরের বইয়ের তিনটি কাজ বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। বাকি সব বই দেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তৈরি করা হচ্ছে। এদিকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পর এবার দেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের পথ উন্মুক্ত হতে চলেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই মাতৃভাষায় পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ওরাও ও গারো জগগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ। পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে অন্যান্য আদিবাসী শিশুরাও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ইতোমধ্যেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসটিবির কর্মকর্তারা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষার পাঠ্যবই প্রণয়ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। আগামী বছর প্রথম দিন থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। প্রথমবারের মতো তাই চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদ্রি ও গারো ভাষায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্য বই। জানা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার থাকলেও গত দুই দশক তা ছিল স্বপ্ন। সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাখের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও স্বীকৃত। তারপরও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল এটি কেবলই স্বপ্ন। তবে সে স্বপ্ন পূরণেই এবার এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এনসিটিবি জানিয়েছে, চার বছর আগে প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা (এমএলই) বিষয়ক জাতীয় কমিটিও গঠন করেছিল সরকার। পুস্তক ছাপানোর প্রস্তুতির নানা ধাপ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তা ছাপা হচ্ছে। বিষয়টির প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী। তিনি বলছিলেন, আগামী জানুয়ারি থেকে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের হাতে মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই পৌঁছে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে মোট ২৪ হাজার ৬৪৬ জন শিশুর জন্য বই ও শিক্ষা উপকরণ ছাপানো হচ্ছে। এ বিশেষজ্ঞ জানান, আমাদের পবিত্র সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারের কথা সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও স্বীকৃত। তারপরও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল এটি কেবলই স্বপ্ন। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের হাতে দ্রুত মাতৃভাষায় পাঠ্যবই তুলে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তাগাদা দিয়েছেন। নজর রাখছেন সব সময়। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগের কারণেই আমরা আজ এ কাজটি করতে পারছি। অন্যথায় এ কাজ সফল করা সম্ভব হতো না বলে জানান এনসিটিবির এই সদস্য। বইগুলো লেখা, সম্পাদনা, চিত্রায়ন প্রভৃতি কাজ শেষ হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতির চিত্রায়নসহ আনুষঙ্গিক বিষয় দিয়ে বইগুলো সাজানো হয়েছে। যে পাঁচটি জনগোষ্ঠীর ভাষায় বই ছাপানো হচ্ছে সেগুলো হলোÑ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও ওরাও। অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী জানান, পাঁচটি ভাষায় বই হচ্ছে। চাকমাদের বই তাদের নিজস্ব বর্ণমালায় ছাপা হচ্ছে। গারোদের আচিক ভাষা হলেও তাদের বর্ণমালা নেই। তারা মূলত রোমান বর্ণমালায় তা পড়ে থাকে। তাই তাদের বই হবে রোমান বর্ণমালায়। মারমাদের বই মামরা ভাষায় হলোও তাদের যেহেতু নিজস্ব বর্ণমালা নেই তাই বই হবে বাংলা বর্ণমালায়। ত্রিপরাদের ভাষা ককবরক। তবে তাদের বইও হবে বাংলা বর্ণমালায়। ওরাও জনগোষ্ঠীর ভাষা সাদ্রি। তাদের বইও হবে বাংলা বর্ণমালায়। এনসিটিবি সূত্র জানায়, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বইয়ের হরফ সম্পর্কে নানান মত আসায় এ বছর তাদের জন্য বই ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। সাঁওতালদেরও প্রতিনিধিরা কেউ বাংলা এবং কেউ রোমান লিপিতে বই লেখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। পরবর্তী বছর থেকে তাদের বই নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীও পাবে নিজস্ব ভাষায় বই। জানা গেছে, ২০১৮ সালে দেয়া হবে আদিবাসী শিশুদের প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যবই। এর পরের বছর ২০১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও মাতৃভাষায় বই দেয়া হবে। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা কোন শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পাবে? এনসিটিবির সদস্য ড. রতন সিদ্দিকী বলেন, সাধারণভাবে বলা যায় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত তারা এ সুযোগ পাবে। তবে দ্বিতীয় শ্রেণীর পর তৃতীয় শ্রেণী থেকে তাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজী প্রভৃতি বই পড়তে হবে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে এই দুইয়ের মধ্যে ‘ব্রিজিং’ শুরু হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে তারা পুরোপুরি জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। শিক্ষানীতির ভাষায় এটা হচ্ছে ‘ব্রিজিং’। কোন শিশুকে ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়া জরুরী। এরপর সে ধীরে ধীরে মাতৃভাষার সঙ্গে অন্য ভাষায় (বাংলাদেশের জন্য বাংলা) শিক্ষা নেবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় সাত বছর। এ সময়টাকে বলে ‘ব্রিজিং পিরিয়ড’। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
×